রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর দুই রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বৈরিতা চরমে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নানা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার ওপর। বসে নেই রাশিয়াও। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতাদের ওপর পাল্টা অবরোধ আরোপ করেছে তারাও। কিন্তু এর মধ্যেই রাশিয়ান বংশোদ্ভূত অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিক্তর বোটকে মুক্তি দেবে বলে রাশিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিনিময়ে রাশিয়ার হাতে আটক জনপ্রিয় বাস্কেটবল খেলোয়াড় ব্রিটনি গ্রিনার ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক মেরিন সদস্য পল হিলানকে ফেরত চাইছে ওয়াশিংটন।
ভিক্তর বোট একসময় মৃত্যুর ফেরিওয়ালা (মার্চেন্ট অব ডেথ) নামে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে ২৫ বছরের সাজা ভোগ করছেন তিনি। কিন্তু কে এই ভিক্তর বোট? তাঁর সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে? চলুন জেনে নেওয়া যাক:
কে এই ভিক্তর বোট?
ধারণা করা হয়, ১৯৬৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত শাসিত তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে ভিক্তর বোটের জন্ম হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীতে দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ১৯৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর উড়োজাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবসায় যুক্ত হন।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ভিক্তরের বাবা একজন অটোমেকানিক ছিলেন, মা ছিলেন বুককিপার। তাঁর একটি ভাই ছিল। ২০১০ সালে জার্মানির সাময়িকী ডার স্পিগেল–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিক্তর বোট ছিলেন রোমাঞ্চপ্রিয় তরুণ। হাতখরচের জন্য বাড়তি টাকা উপার্জন করতে নিষিদ্ধ পপ গান কপি করতেন। পরবর্তী জীবনে প্রয়োজন হবে ভেবে এসপেরান্তো ভাষাও শেখেন তিনি।
তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট ইউনিয়ন অব ইয়ুথ–এ যুক্ত হন ভিক্তর বোট। সে সময় মস্কোর মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। মিলিটারি ইনস্টিটিউটে থাকাকালে দোভাষী হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁকে মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলায় পাঠানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু কার্গো বিমান কেনেন ভিক্তর বোট। এর মাধ্যমে বিমানে পণ্য পরিবহন ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
ধীরে ধীরে বড় ব্যবসায়ী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন ভিক্তর বোট। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডগলাস ফারাহ ও স্টিফেন ব্রাউনের লেখা ‘মার্চেন্ট অব ডেথ’ বইটি লেখা হয়েছিল ভিক্তর বোটকে নিয়ে। ধারণা করা হয়, ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া হলিউডের চলচ্চিত্র ‘লর্ড অব ওয়ার’–এ নিকোলাস কেজ যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেটি ভিক্তর বোটের জীবনাচরণ ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছিল।
আফ্রিকা থেকে আফগানিস্তান ও ইরাক
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভিক্তর বোট একসময় বৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ফ্রান্স সরকারের সঙ্গে লেনদেন করতেন। তবে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভাষ্যমতে, আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিয়ন, লাইবেরিয়া ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে সেখানে অস্ত্র ব্যবসা করেছেন ভিক্তর বোট।
এ ছাড়া নব্বইয়ের দশকে আফগানিস্তানে চলে যাওয়ার কথা নিজেই স্বীকার করেছেন ভিক্তর বোট। তবে সেখানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে তালেবানকে অস্ত্র সরবরাহের কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।
২০০৩ সালে রাসায়নিক অস্ত্র মজুতের অভিযোগ এনে ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। নথিপত্রে জানা গেছে, ওই সময় ইরাকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য বেশ কিছু কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলোর মধ্যে ভিক্তর বোটের কোম্পানিও ছিল।
ওই সময় যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার হেইন বলেছিলেন, ভিক্তর বোট একজন নেতৃস্থানীয় ‘মৃত্যুর ফেরিওয়ালা’। তিনি পূর্ব ইউরোপ, বিশেষ করে বুলগেরিয়া, মলদোভা ও ইউক্রেন থেকে আফ্রিকার লাইবেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত অস্ত্র বহনকারী বিমান ও সরবরাহ রুটের প্রধান বাহক।
কীভাবে গ্রেপ্তার হলেন?
ইরাক যুদ্ধে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিক্তর বোটের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। কিন্তু ২০০০ সালের শুরু থেকেই তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ভিক্তর বোটকে অভিযুক্ত করা যায় এমন কোনো আইন না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষকে পিছু হটতে হয়।
পরে ২০০৮ সালে ভিক্তর বোটকে গ্রেপ্তারে একটি কৌশল বের করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির কয়েকজন এজেন্টকে কলম্বিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফার্ক-এর ক্রেতা সাজানো হয়।
তাঁরা সরাসরি ভিক্তর বোট ও তাঁর কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করতে সমর্থ হন। ভিক্তর বোটের সঙ্গে সম্ভাব্য অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে আলোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্টরা। এর পরপরই থাইল্যান্ড সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে ভিক্তরকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
ভিক্তর বোটের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক অস্ত্র কেনাবেচার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে আসছে যে নব্বই দশকের শুরু থেকেই তিনি অস্ত্র পাচারের সঙ্গে জড়িত। সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১২ সালে ভিক্তর বোটকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভিক্তর বোটের সাজা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসেছে। তারা এ সাজা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আসছে। কয়েক বছর ধরেই ভিক্তর বোটের মুক্তি দাবি করে আসছে ক্রেমলিন।
বন্দিবিনিময় নিয়ে কতটুকু জানা গেল
অলিম্পিকে স্বর্ণপদকজয়ী গ্রিনারকে গাঁজার নির্যাস বহনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে রাশিয়া। আর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সাবেক মেরিন সেনা হিলানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজনই বর্তমানে রাশিয়ার কারাগারে আছেন। তাঁদের মুক্তির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি করতে রাজি। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, রাশিয়া তাদের দুই নাগরিককে বেআইনিভাবে আটকে রেখেছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, তাঁদের মুক্তির জন্য কয়েক সপ্তাহ আগেই আলোচনার টেবিলে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আল–জাজিরা অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে