যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টি কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির কাছে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। রিপাবলিকানদের কাছে প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ হারানোয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাইডেনের ক্ষমতা কিছুটা কমবে। এতে ইউক্রেনকে মার্কিন সহায়তার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, কিয়েভকে উদারহস্ত সহায়তায় আপত্তি আছে রিপাবলিকানদের। এ নিয়ে জেনেভা সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির নির্বাহী ফেলো আহমাদি আলির আল-জাজিরায় লেখা এক মতামত কলামের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাপার হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা গেল, ভোটারদের অন্য চিন্তাভাবনা ছিল। হ্যাঁ, তাঁদের কাছে মূল্যস্ফীতি ও গ্যাসের উচ্চমূল্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু নিজেদের শরীরের বিষয়ে নারীদের অধিকার আরও ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা ছিল। অধিকাংশ আমেরিকানের মাথায় ছিল বিষয়টি। এর ফলাফল হলো—এখন এক ভোটের ব্যবধানে সিনেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে ডেমোক্র্যাটদের।
অবশ্য প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন ডেমোক্র্যাটরা। নিম্নকক্ষে সামান্য ব্যবধানে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাকি মেয়াদে বাইডেনের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অভ্যন্তরীণ শাসনকার্য থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতিতেও একটি বিভক্ত সরকারের উল্লেখ্যযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে। এসবের মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেন থেকে শুরু করে চীন ও নিষেধাজ্ঞার মতো বিষয়গুলোও।
ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পুরোদমে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এর পর থেকে কিয়েভের জন্য ৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সহায়তার অনুমোদন দেয় মার্কিন কংগ্রেস। গত সপ্তাহে বাইডেন প্রশাসন অতিরিক্ত আরও ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার অনুমোদন দিতে কংগ্রেসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তার বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দ্বিদলীয় সমর্থন ছিল।
বৃহত্তর দ্বিতীয় সমর্থন নিয়ে এ ধরনের সবচেয়ে বড় বরাদ্দ মে মাসে পাস হয়েছিল। ওই সময় প্রতিনিধি পরিষদের মাত্র ৫৭ জন সদস্য ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। অবশ্য এই আইনপ্রণেতাদের সবাই ছিলেন রিপাবলিকান। প্রতিনিধি পরিষদের মোট আসন ৪৩৫টি।
কিন্তু ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিকভাবে কীভাবে সমর্থন দেওয়া হবে, তা নিয়ে রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে থাকা গভীর বিভক্তি মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় প্রকাশ পায়। ওহাইও অঙ্গরাজ্য থেকে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান জেডি ভ্যান্স। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ এই মিত্র জোর দিয়ে বলেন, ‘শেষ নাগাদ ইউক্রেনে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করা প্রয়োজন কংগ্রেসের।’
উগ্র ডানপন্থী ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী নারী কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেলর গ্রিন। তিনি জর্জিয়া থেকে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে এক প্রচার শোভাযাত্রায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘রিপাবলিকানদের অধীনে আর একটি পয়সাও ইউক্রেনে যাবে না।’ ভোটের পর তিনি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়ের নিরীক্ষা (অডিট) চেয়ে কংগ্রেসে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন।
প্রতিনিধি পরিষদে বিরোধী নেতার দায়িত্বপালন করে আসা কেভিন ম্যাককার্থি রিপাবলিকানদের জয়ের ফলে পরবর্তী স্পিকার হতে যাচ্ছেন। অক্টোবরে তিনি বলেছিলেন, প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে ইউক্রেন আর ‘ফাঁকা চেক’ পাবে না।
ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তা বন্ধে গ্রিনের সুপারিশ রিপাবলিকান পার্টি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। সম্ভবত দলটির নেতৃত্ব ইউক্রেনসম্পর্কিত বরাদ্দে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাড়াতে চাইবেন। এমনকি আর্থিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও আরোপ করতে পারেন।
অবশ্য উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, জাতীয় নিরাপত্তা দেখভালের দায়িত্বে থাকা নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে নিজের ‘ফাঁকা চেক’ মন্তব্য থেকে ম্যাককার্থি ইতিমধ্যে সরে এসেছেন বলে জানা গেছে। ইউক্রেনের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই বলেও নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন তিনি।
এটাও মনে রাখা উচিত, ট্রাম্পের কথাবার্তা প্রায়ই রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করা হতো। কিন্তু তখনো তাঁর প্রশাসন রাশিয়ার ওপর বিস্তৃত মাত্রায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ৪০ দফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। তাই রিপাবলিকানরা মস্কোর বিরুদ্ধে চলমান নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র যদি আরও বাড়াতে চান, তাহলে আমাদের কারোই অবাক হওয়ার কিছু নেই।
রিপাবলিকানদের প্রতিনিধি পরিষদ নিয়ন্ত্রণের ফলে বাইডেন প্রশাসনের যেকোনো অভ্যন্তরীণ ও আইনসভাসম্পর্কিত অ্যাজেন্ডা আটকে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে দেখা যায়, যখন অভ্যন্তরীণ নীতিতে বিজয়ের সম্ভাবনা কম থাকে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টরা ঐতিহাসিকভাবে পররাষ্ট্রনীতির কৃতিত্বের দিকে ঝুঁকেছেন।
আমরা বাইডেনের কাছ থেকে পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে আরও সক্রিয়তা দেখতে পারি। কারণ, তিনি তাঁর অর্জনের স্মারক রেখে যাওয়ার বিষয়ে নজর দিয়েছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কি না, সে ঘোষণা এখনো দেননি বাইডেন।
কিন্তু যে সিদ্ধান্তই তিনি নেন না কেন, সেখানে বড় ঝুঁকি রয়েছে। এমন একটি সময়, যখন মহামারির পরপরই বড় একটি যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও খাদ্য সরবরাহকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। একটি বিভক্ত কংগ্রেস রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে যে পররাষ্ট্রনীতিতে কে বেশি মরিয়া হতে পারে। এটি চীন ও বাণিজ্যসুরক্ষাবাদ থেকে শুরু করে ইউক্রেনকে অর্থসহায়তাসহ প্রত্যেকটি নীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
প্রতিনিধি পরিষদে নতুন রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ইউক্রেনে সহায়তার মতো ইস্যুতে ঐক্য বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ইতিমধ্যেই অস্থির বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যা আশা করতে পারে, তা আবারও অনিশ্চয়তায় পড়েছে।