ইলন মাস্ক কী চাইছেন

ইলন মাস্ক ও টুইটার
রয়টার্স ফাইল ছবি

বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক যখন গত সপ্তাহে টুইটার কিনে নিলেন, তখনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল টুইটার পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসছে। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম ইলন মাস্কের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। প্রথম দিকে ইলন মাস্ক যখন টুইটার কেনার পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, তখন তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ডানপন্থী বা মধ্য ডানপন্থীদের কথা বলার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে একে দাঁড় করানো। এর জন্য তিনি ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাম হাঁকেন। কিন্তু টুইটারের মালিক হওয়ার পর তাঁর চাওয়া বদলে গেছে। তিনি এখন একে ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম হিসেবেই দেখছেন।

শুরুতে প্রবল আগ্রহ দেখালেও মাঝপথে টুইটারে ভুয়া অ্যাকাউন্টের তথ্য না পাওয়ার অভিযোগে পিছুটান দিয়েছিলেন ইলন মাস্ক। টুইটার কর্তৃপক্ষ অনেকটা নাটকীয়ভাবে আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং ইলন মাস্ককে টুইটার কিনে নিতে বাধ্য করে। কিন্তু ততদিনে মাস্ক তাঁর বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য সুস্পষ্ট ব্যবসায়িক পরিকল্পনা বেঁধে ফেলেছেন। জনগণকে বিনা মূল্যে টুইটার ব্যবহার করতে দেওয়ার চেয়ে এটাকে ব্যবসাবান্ধব করার দিকটিতেই গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। তিনি তাঁর বিনিয়োগকারী ব্যাংক কর্মকর্তা, তাঁর গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার শেয়ারধারী ও টুইটারের বিজ্ঞাপনদাতাদের আশ্বস্ত করেন যে, টুইটারকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছেন তিনি।

ইলন মাস্ক টুইটার নিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা হয়তো অনেক ব্যবহারকারীর টুইটারের অভিজ্ঞতাকে আরও নাড়িয়ে দেবে। ইতিমধ্যে টুইটারের সম্পাদনার ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। অর্থাৎ, টুইট সম্পাদনার বিষয়টিকে তিনি বিশেষ ফিচার হিসেবে দেখছেন। তাঁর এ পদক্ষেপ অবশ্যই ব্যবসায়িক দিক বিবেচনায় নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে আদর্শিক দিকের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনিতেই টুইটার পরিচালনার দিক থেকে কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই লোকসানে রয়েছে। ইলন মাস্কের নতুন পদক্ষেপে টুইটারের হয়তো লোকসান হতে পারে। তবে অনেকের যে ধরনের আশঙ্কা ছিল ঠিক ততটা লোকসান হবে না।

টুইটার এখন দ্রুত পুরোপুরি ব্যবহার অযোগ্য প্ল্যাটফর্মে পরিণত হতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এর পেছনে কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ইলন মাস্কের নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত। তিনি এখন টুইটারের প্রধান নির্বাহী। তাঁর এ অবস্থান থেকে টুইটার থেকে ব্যাপক অর্থ আয় করার কথা ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। এটাই টুইটারকে ব্যবহার অযোগ্য করে তুলতে পারে। টুইটার আগে থেকেই অর্থ আয়ের বড় কোনো প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত নয়। এখন এ পরিস্থিতি বদলাতে গেলে মাস্ককে নতুন নতুন দিকে ছুটতে হবে। প্ল্যাটফর্মে এমন কিছু পরিবর্তন আনতে হবে যাতে টুইটারকে ভিন্ন একটি চেহারায় দেখা যেতে পারে। টুইটার আর তার আগের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারবে না। এতে টুইটার আরও ভালো জায়গা হয়ে উঠবে এমন নিশ্চয়তা কম।

ইলন মাস্ককে এখন যে পথে হাঁটতে হবে, তা টুইটার ব্যবহারকারীদের কাছে এর মূল্য শূন্যে নামিয়ে আনতে পারে। টুইটারকে ইন্টারনেটের আরও আকর্ষণীয় ও পছন্দসই স্থান হিসেবে দাঁড় করানোর পরিবর্তে তিনি বর্তমানে টুইটার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেই অর্থ আদায়ের দিকে ছুটতে শুরু করেছেন। যাঁরা অর্থ দিয়ে টুইটার ব্যবহার করবে না, তাঁদের জন্য টুইটার প্ল্যাটফর্মটিকে আরও বাজে স্থান হিসেবে দাঁড় করানোর হুমকি দিয়ে রেখেছেন তিনি। মাস্ক যদি টুইটারকে অর্থ ছাপানোর যন্ত্র ভেবে থাকেন, তবে তিনি সমস্যায় পড়বেন। তাঁকে বুঝতে হবে, প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালনা পর্ষদ কেন এত দ্রুত তাঁর ওপর টুইটারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ছিল! ইলন মাস্ককে যদি এখন টুইটারকে আরও বেশি লাভজনক করে তুলতে হয় তবে তাঁকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে মানুষ এখানে সময় কাটানোর জন্য আরও বেশি ভালো স্থান হিসেবে মনে করেন। কিন্তু ইলন মাস্ক এখন পর্যন্ত তাঁর যেসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তাতে মনে হয় না তিনি এ পথে সহজে হাঁটবেন।

প্রযুক্তি বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ভার্জ ইলন মাস্কের প্রাথমিক এক ধারণার কথা তুলে ধরেছে। তাতে বলা হয়, টুইটারে ব্যবহারকারীদের ভেরিফায়েড থাকতে মাসে ২০ মার্কিন ডলার করে দিতে হবে। যাঁরা অর্থ দেবেন না তাঁদের ‘নীল টিক’ বা ব্লু ব্যাজ সরিয়ে নেওয়া হবে। ইলন মাস্ক বলেছেন, টুইটারে বিনা মূল্যের জমানা শেষ। একাধিক বড় পরিবর্তন আসছে জানিয়ে ইলন মাস্ক বলেন, টুইটারে নীল টিকচিহ্ন বা ‘ব্লু টিক’-এর জন্য খরচ করতে হবে। গত মঙ্গলবার ইলন মাস্ক নিজেই টুইটারে নানা পরিবর্তন আনার কথা জানিয়ে টুইট করেন। তিনি বলেন, এবার থেকে টুইটার ব্যবহারকারীরা চাইলেই নিজেদের অ্যাকাউন্ট ‘ভেরিফায়েড’ করে নিতে পারবেন। তবে এর জন্য খরচ করতে হবে। টুইটার অ্যাকাউন্টে নামের পাশে ব্লু টিক যোগ করতে প্রতি মাসে পকেট থেকে খসবে কয়েক ডলার। আপাতত প্রতি মাসে আট ডলার খরচ করতে হবে অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড করানোর জন্য। বিভিন্ন দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে এ দাম বা খরচ নির্ধারণ করা হবে বলেই জানান ইলন মাস্ক। টুইটার অ্যাকাউন্টটি আসল ও বিশ্বাসযোগ্যের প্রমাণ হচ্ছে, এই নীল টিকচিহ্ন।

অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড করাতে অর্থ নেওয়ার বিষয়টি ইলন মাস্কের স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন একটি ব্যবসায়িক ধারণা। কিন্তু এখানে একটি সমস্যা রয়ে গেছে। নীল টিক যাঁরা পান, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে যেহেতু দেখা হয়, এ সুযোগটি এখন নিতে পারবেন দুর্বৃত্তরাও। কেউ এটা কিনে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর কাজে লাগাতে পারেন। টুইটারকে আগে থেকেই ভুয়া তথ্য ছড়ানোর অভিযোগের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে টুইটারের সমস্যা আরও বাড়বে। এটি মানুষের কাছে আকর্ষণ হারাবে।

টুইটারের এ ধরনের পদক্ষেপে গণমাধ্যম ও তারকা ব্যবহারকারীদের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হবে। কারণ গণমাধ্যম ও তারকাদের টুইট অনেক লোকজনকে এ প্ল্যাটফর্মে টেনে আনে। তারা বিনা মূল্যেই টুইট করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে কেউ যদি এখন বলেন, তাঁরা আর বিনা মূল্যে টুইট করবেন না? এতে টুইটারে আর তথ্য জানানোর জন্য ভালো পরিবেশ থাকবে না। যাঁরা ইলন মাস্ককে পছন্দ করেন না এমন টুইটার ব্যবহারকারী এ প্ল্যাটফর্ম ছাড়লে বিপদেই পড়ে যাবেন মাস্ক।

ইলন মাস্ক অবশ্য বলেছেন, আট ডলার দিয়ে ভেরিফায়েড থাকার বিনিময়ে বেশ কিছু অগ্রাধিকার সুবিধা দেওয়া হবে ব্যবহারকারীকে। অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হয়ে নীল টিকচিহ্ন থাকলে ব্যবহারকারীরা রিপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগণ্যতা পাবেন। কেউ ‘মেনশন’ করলে বা ‘সার্চ’ করলেও ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টগুলো আগে দেখাবে। এ ছাড়া লম্বা ভিডিও বা অডিও পোস্ট করা যাবে। অর্ধেকের কম বিজ্ঞাপন দেখতে হবে ভেরিফায়েড টুইটার ব্যবহারকারীদের।

বর্তমানে টুইট ছড়ায় গণতান্ত্রিকভাবে। যদি কেউ অনেক বেশি রিটুইট, লাইক, রিপ্লাই পান তবে তাঁর টুইট আরও বেশি লোক দেখতে পান। কিন্তু মাস্ক যে টুইটারের ধারণা দিচ্ছেন তাতে অর্থ দিয়ে ব্যবহারকারী তাঁর টুইটকে আরও বেশি মানুষকে দেখাতে পারবেন। অর্থাৎ, অর্থদাতার পোস্ট অগ্রাধিকার পাবে। এই পরিকল্পনা মূলত টুইটারে যাঁরা অর্থ দিয়ে বিজ্ঞাপন দেন, তাঁদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু ভেরিফায়েড নীল টিক ক্রেতাদের ধারণাটি বিজ্ঞাপনদাতারাও পছন্দ করছেন না। তাঁরা চান টুইটার এমন একটি স্থান হোক যাতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কোন বিজ্ঞাপন দেখবে সেটি নির্ধারণ করা হবে। তাঁরা ৮ ডলার দিয়ে পোস্টদাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে চান না।

টুইটারের আর্থিক অবস্থা ভালো করার জন্য মাস্কের আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এর একটি হচ্ছে ব্যাপকহারে কর্মী ছাঁটাই করা। টুইটারের কর্মী ছাঁটাই করে তিনি অর্থ বাঁচাতে পারবেন। একদিকে কর্মী ছাঁটাই করে বাঁচানো অর্থ ও অন্যদিকে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আয় করে তিনি টুইটারকে রক্ষা করতে চান। কিন্তু ইলন মাস্কের পরিকল্পনার মধ্যে কোথাও নেই যে, মানুষ এখানে কীভাবে সময় কাটাবে। অবশ্য তিনি এর মধ্যে ভাইন নামের ছোট ভিডিও প্ল্যাটফর্মটিকে ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এখান থেকে অর্থ আয় করতে না পেরে আগেই এটি বন্ধ করে দিয়েছিল টুইটার কর্তৃপক্ষ। ভাইন ফেরত এনে এখান থেকে অর্থ আয়ের একটা পথ ইলন মাস্ক নিশ্চয়ই বের করবেন তা আগের কর্তৃপক্ষ পারেনি।

এর বাইরেও আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। তিনি এমন কিছু ফিচার আনতে পারেন যাতে ব্যবহারকারীর বিরক্তি কাটিয়ে তাদের দরকারি অভিজ্ঞতাগুলো এখন থেকে পাবেন। তিনি টুইটারে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরির মতো টুইটার সার্কেল আনতে পারেন। এ ছাড়া নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যবহারকারীর জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যুক্ত করা হতে পারে। এর বাইরে টুইটারের টুইট ডেকের মতো দরকারি টুলগুলো কাজে লাগাতে পারেন তিনি।

তবে টুইটারের এতদিন ধরে চলা ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তের প্রতিটিতে তিনি নাক গলালে তাঁকে আরও কঠিন সময় দেখতে হতে পারে। তিনি টুইটার কেনার সময় শেয়ারপ্রতি ৫৪ দশমিক ২০ ডলার করে পরিশোধ করেছেন। কিন্তু এত অর্থ তিনি টুইটারের পেছনে ঢালতে রাজি ছিলেন না শেষ পর্যন্ত। এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও না পারা ইলন মাস্কের জন্য টুইটার আর্থিক লোকসানের বোঝা হবে কি না দেখার সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু তিনি যদি লোকসান থেকে বের হতে পারেন তবে তা হবে তাঁর ডানপন্থীদের তুষ্ট করার চেয়ে তাঁর ব্যবসায়িক কৌশলের জয়। ইলন মাস্ক টুইটারের জন্য কোনটা ভালো তা যতোটা দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবেন তত দ্রুত তিনি সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবেন।

রয়টার্স, এএফটি ও স্লেট ম্যাগাজিন অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন