হেনরি কিসিঞ্জারের হাতে বাঙালির রক্ত

সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার গত বুধবার মারা গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহে ভূমিকা রেখেছিলেন, যা বাঙালিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে গতকাল শুক্রবার ওয়াশিংটন পোস্ট-এ লিখেছেন ঈশান থারুর। 

হেনরি কিসিঞ্জার

শততম জন্মদিন পেরোনোর কয়েক মাস পর মারা গেলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্রের ‘খ্যাতিমান কূটনীতিক’ হিসেবে মৃত্যুর পরও অনেকের প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি। ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতার মুখে কিশোর বয়সে ইহুদি উদ্বাস্তু হিসেবে জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের ‘ডান হাত’ হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিন কূটনীতির হাল ধরেছিলেন তিনি। আবার চীনের অদম্য উত্থান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন প্রযুক্তির এই যুগে নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা—সবকিছু মিলিয়ে তাঁর শতবর্ষী জীবনকালকে স্মরণ করা হচ্ছে।

জীবনের শেষ দিনগুলোতেও এই খ্যাতি ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রেখেছিলেন কিসিঞ্জার। তিনি ছিলেন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করা মানুষদের শিরোমণি। একই সঙ্গে ক্ষমতার পরিবর্তন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি, যার ফলে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ‘ভবিষ্যদ্বক্তা’ হিসেবেও।

কিসিঞ্জারের স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি, দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে কয়েক প্রজন্মের নীতিনির্ধারকেরা তাঁকে নিয়ে অভিভূত। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার একবার বলেছিলেন, ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনীতি যদি একটি শিল্প হয়ে ওঠে, তাহলে হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন কূটনীতির একজন শিল্পী।’

তবে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই কিসিঞ্জারের এই জীবন প্রশংসনীয় নয়। কম্বোডিয়ায় নির্দয় ও নির্বিচার বোমাবর্ষণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা এবং খেমাররুজের গণহত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত তাণ্ডবকে পরোক্ষভাবে কিসিঞ্জারের সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে আমার সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন। স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিষ্ঠুর ও নির্দয়ের মতো অবস্থান নিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। এ কারণে তিনি বিশ্বজুড়ে বহু দেশে নৃশংস হামলা ও সহিংসতা দেখেও চোখ বুজে থেকেছেন। অনেক ক্ষেত্রে এসব সহিংসতা উসকে দিয়েছেন তিনি। 

লাতিন আমেরিকার ডানপন্থী জান্তাদের নোংরা যুদ্ধ, আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী সংখ্যালঘু সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুর আক্রমণে ইন্দোনেশিয়ার একনায়ককে সবুজসংকেত দেওয়াসহ বিশ্বজুড়ে এমন অনেক ঘটনায় তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের হাত ছিল। পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার ওই সামরিক আগ্রাসন ও এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে ছোট্ট দ্বীপটির প্রায় দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।

কিসিঞ্জারকে নিয়ে জানতে চাইলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস-হোর্তা এ সপ্তাহে আমার এক সহকর্মীকে বলেন, ‘যাঁরা ইতিহাস জানেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের (কিসিঞ্জারের) এই অতীত সম্পর্কে জানার কথা, যা দুঃখজনক এবং কুৎসিত।’

তবে কিসিঞ্জারের এই অতীত সম্পর্কে বেশির ভাগ আমেরিকান ওয়াকিবহাল নন, কেউ কেউ জানলেও তা খুব কমই স্মরণ করতে পারেন। এ কথা সত্য, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সময় হেনরি কিসিঞ্জার ও রিচার্ড নিক্সনের ভূমিকা কী ছিল, তা দিয়েই কিসিঞ্জারকে মনে রাখবেন দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। ভৌগোলিকভাবে তখন পাকিস্তানের ছিল দুটি অংশ। দুই অংশের মধ্যে দূরত্ব ছিল হাজার মাইলের। এই দুই অংশের মাঝখানে ছিল ভারত। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনারেলদের অধিকাংশই ছিল জাতিগতভাবে পাঞ্জাবি। তারা দেশের পূর্ব অংশের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের অবজ্ঞা করত।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে গণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হন বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবিরা নির্বাচিত বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি শুরু করে। এতে শুরু হয় এক রাজনৈতিক সংকট। 

গেরিলাযুদ্ধে যাওয়ার আগে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও কিসিঞ্জার

রাজনৈতিক সংকটের এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর সেনা অভিযান শুরু করে পাকিস্তানি জেনারেলরা। মুহূর্তেই তা গণহত্যায় রূপ নেয়। সংখ্যালঘু হিন্দু, ছাত্র, ভিন্নমতাবলম্বী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর বিরোধী মানুষকে নির্বিচার হত্যা করতে থাকে পশ্চিমা পাকিস্তানি সেনারা।

তখন মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস-এর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি ছিলেন সিডনি শ্যানবার্গ। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে ‘বিস্তৃত পরিসরে একটি গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করে শ্যানবার্গ বলেছিলেন, সেই ভূমিতে (মৃতদেহ খেয়ে) ‘শকুনেরাও মোটা হয়ে উঠছে’। লাখ লাখ নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর এক গ্রাম, জনশূন্য হয়ে পড়েছে নগরের পর নগর। 

এ অবস্থায় শরণার্থীর ঢল নামে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতে। কয়েক মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি হয়। অনেকের মতে, এই সংখ্যাটা প্রায় ৩০ লাখ। ধানখেতে পড়ে ছিল মরদেহ। নদ-নদী দিয়ে ভেসে সাগরে পড়েছিল মরদেহ।

বর্বর এই হত্যাকাণ্ড দেখে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি দেখে শেষে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। কিন্তু এরপরও হোয়াইট হাউস ছিল পাকিস্তানি জেনারেলদের পক্ষে। কারণ, স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের এই জেনারেলরাই ছিল ওয়াশিংটনের মিত্র এবং ওই বছরের এপ্রিলে কিসিঞ্জার যে এক গোপন মিশনে চীন সফর করেছিলেন, তাতে যাবতীয় সহায়তা দিয়েছিল পাকিস্তান। 

গ্যারি ব্যাসের বইয়ে যা আছে

সোভিয়েতপন্থী ভারতীয়দের বিশ্বাস করতেন না কিসিঞ্জার। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করেননি তিনি। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের এই হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি নিয়ে দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড (রক্তমাখা বার্তা: নিক্সন, কিসিঞ্জার ও বিস্মৃত এক গণহত্যা) নামে দারুণ একটি বই লিখেছেন গ্যারি ব্যাস। তাঁর বইয়ে গণহত্যার বিষয়ে মাঠপর্যায় থেকে তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে যে সতর্ক করেছিলেন, সে বিষয়টি উঠে এসেছে।

তখন মাঠপর্যায় থেকে মার্কিন কূটনীতিকদের দেওয়া তথ্য ও তারবার্তাগুলোকে অগ্রাহ্য করেছিলেন কিসিঞ্জার। তাঁদের চোখের সামনে একটি গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে জানিয়ে সতর্ক করলেও মার্কিন কূটনীতিকদের পাঠানো তথ্য ও তাঁদের তারবার্তা সেই সময়কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আমলেই নেননি।

বাঙালিদের ওপর চলমান এই গণহত্যা থেকে পাকিস্তানি জেনারেলদের বিরত রাখতে নিক্সন বা কিসিঞ্জার—কেউ-ই নিজেদের ক্ষমতার ন্যূনতম ব্যবহার করেননি; বরং গোপনে পাকিস্তানকে অস্ত্র-গোলাবারুদ পাঠানোর কাজে গতি বাড়ান তাঁরা। এখানে শেষ নয়, কংগ্রেসের দেওয়া অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেই তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠিয়েছিল নিক্সন প্রশাসন। সেই সময় যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা ও তাঁদের মিত্র ভারত ছিল সুবিধাজনক অবস্থানে।

গ্যারি ব্যাস তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘চলমান সেই গণহত্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকার পরও গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাঙালিদের গণহত্যা, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হাতে পাকিস্তানের শোচনীয় পরাজয় পর্যন্ত নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পক্ষে অনড় অবস্থানে ছিলেন।’

গ্যারি ব্যাস তাঁর বইয়ে আরও তুলে ধরেছেন, বাস্তববাদী রাজনীতির এই ধ্বজাধারীরা প্রায়ই কীভাবে আবেগতাড়িত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি তাঁদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছিল।

কখনো ভুল স্বীকার করেননি কিসিঞ্জার

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর থেকে পাঁচ দশকের বেশি সময় চলে গেছে। কিন্তু কখনোই নিজের এই ভুল স্বীকার করেননি কিসিঞ্জার। ‘বরং নিজের কৃতকর্মের কারণে অসংখ্য প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে কিসিঞ্জার দক্ষিণ এশিয়া সংকট নিয়ে তাঁর ভুলত্রুটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।’—কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর গত বৃহস্পতিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য আটলান্টিক-এ এভাবেই লিখেছেন গ্যারি ব্যাস। 

গ্যারি ব্যাস আরও লিখেছেন, ২০২২ সালের শেষ দিকে লিডারশিপ নামে কিসিঞ্জারের একটি বই প্রকাশিত হয়। সেখানেও তিনি তাঁর ওই কৃতকর্মের ক্ষেত্রে নিজেকে বাঁচিয়ে অনেকটা দায়সারা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এই বইয়ে কিসিঞ্জার কৌশলে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ‘বিরক্তিকর’ ব্যক্তি বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বারবার ‘বিচ’ এবং ভারতীয়দের ‘বাস্টার্ড’ ও ‘সান অব বিচ’ বলেছিলেন কিসিঞ্জার।

কিসিঞ্জারের মৃত্যুর খবর ঢাকা (বাংলাদেশের মানুষ) নিস্তরঙ্গভাবে নিয়েছে। তাদের এই আচরণে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনগণের বিরুদ্ধে থেকেই মারা গেলেন কিসিঞ্জার। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের সমর্থন দিতে গিয়ে তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইন লঙ্ঘনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তাঁর সামনে ঘটে যাওয়া এই হত্যাযজ্ঞের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

আব্দুল মোমেন আরও বলেন, ‘তাঁর মতো (হেনরি কিসিঞ্জার) একজন স্মার্ট মানুষের জন্য এই ধরনের অমানবিক কাজ করাটা খুবই দুঃখজনক। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’

ঈশান থারুর, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কলাম লেখক, উপস্থাপক, টুডে’স ওয়ার্ল্ডভিউ

● ভাষান্তর: আল-আমিন সজীব