অভিযোগ ৩৪টি। ১২ জন জুরি। সাক্ষীদের সারি। শুনানিতে একজন বিচারকের প্রায়ই উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
প্রায় পাঁচ সপ্তাহ ধরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলার বিচারে এমন সব দৃশ্য দেখা গেছে।
যৌনকর্মীকে ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ রাখার অভিযোগের এ মামলার বিচারকাজ নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের আদালতে চলছে।
মামলাকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। কেননা, ট্রাম্পের আগে আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি বিচারের মুখে পড়েননি।
মামলায় আজ মঙ্গলবার দুই পক্ষের সমাপনী যুক্তিতর্ক শুরু হবে। যুক্তিতর্ক শেষে জুরিরা সিদ্ধান্ত দেবেন।
সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের বিপক্ষে গেলে তিনি হবেন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট।
একই সঙ্গে ট্রাম্প হবেন ফৌজদারি অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে বড় কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে যাওয়া একজন প্রার্থী।
বিচার চলাকালে পুরোটা সময় ট্রাম্প জামিনে মুক্ত আছেন। ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলেও সাজার শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ না করা পর্যন্ত তিনি সম্ভবত মুক্ত মানুষ হিসেবেই আদালত ত্যাগ করতে পারবেন।
ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর সাজার শুনানির জন্য সময় নির্ধারণ করবেন বিচারপতি জুয়ান মার্চান। সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় বিচারককে বিবেচনায় নিতে হবে। এর একটি ট্রাম্পের বয়স। ট্রাম্পের বয়স এখন ৭৭ বছর। আরেকটি বিষয় হলো, ট্রাম্পের আগে কখনো ফৌজদারি অপরাধে আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া।
আদালত ট্রাম্পকে জরিমানা, অবেক্ষণ বা নজরদারিতে রাখা বা কারাভোগের সাজা দিতে পারেন।
দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। আপিল মামলা নিষ্পত্তি হতে কয়েক মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় লেগে যেতে পারে। আপিল চলাকালে জামিন নিয়ে ট্রাম্পের মুক্ত জীবন কাটানোর সুযোগ আছে। তাই আপাতত আদালতকক্ষ থেকে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে ট্রাম্পকে বের করে আনা হচ্ছে—এমন দৃশ্য দেখার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সাবেক পর্ণ তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসে সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে মুখ না খুলতে নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে স্টর্মিকে ঘুষ দিয়েছিলেন তিনি। ঘুষ দেওয়ার কথা তিনি গোপন করেছিলেন।
অভিযোগ বিষয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন স্টর্মি। সওয়াল-জবাবে পুরো ঘটনার খুঁটিনাটি বলেছেন তিনি। তাঁর এই সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ।
নিউইয়র্ক ল স্কুলের অধ্যাপক অ্যানা কমিনস্কি বলেন, আদালতে স্টর্মির খুঁটিনাটি বিবরণ একদিকে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেছে। অন্যদিকে তিনি এমন কিছু বলেছেন, যা বিষয়টিকে অপ্রাসঙ্গিক ও পক্ষপাতদুষ্ট করে ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ রয়েছে, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেআইনি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করা। তবে কিছু আইনবিশেষজ্ঞ বলছেন, সুনির্দিষ্ট কোন আইন ট্রাম্প ভেঙেছেন—সেটা নিয়ে স্পষ্টতার অভাব আছে, যা দোষী সাব্যস্তের রায় চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ করে দিতে পারে ট্রাম্পের আইনজীবীদের।
ট্রাম্প কারাগারে যেতে পারেন। তবে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
যে ৩৪টি অভিযোগের মুখোমুখি ট্রাম্প, সেগুলোর প্রতিটি নিউইয়র্কে ‘ই’ শ্রেণির বা সর্বনিম্ন স্তরের। প্রতিটির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা ৪ বছরের কারাদণ্ড।
ট্রাম্পকে কম সাজা দেওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে আছে তাঁর বয়স বেশি। তিনি আগে কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হননি। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তার কোনোটাই সহিংস অপরাধ নয়। বিচারকের সিদ্ধান্তে এসবের প্রভাব দেখা যেতে পারে।
একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি আসন্ন নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ একজন প্রার্থী, তাঁকে কারাগারে পাঠানো এড়াতে চাইতে পারেন বিচারক।
দোষী সাব্যস্ত হলে ট্রাম্প কি এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে পারবেন? উত্তরটা হলো, ‘হ্যাঁ’।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বলা আছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৩৫ বছর। তাঁকে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হতে হবে। অন্তত ১৪ বছর স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। সব কটি শর্তই ট্রাম্প পূরণ করেছেন।
আর ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ডধারী কাউকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে দেওয়া যাবে না, এমন কোনো শর্ত দেশটির সংবিধানে উল্লেখ নেই। তাই ট্রাম্পের প্রার্থী হতে বাধা নেই।
তবে দোষী সাব্যস্তের বিষয়টি ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্লুমবার্গ ও মর্নিং কনসাল্টের এক জরিপে বলা উঠে আসে, ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ৫৩ শতাংশ ভোটার তাঁকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
চলতি মাসে কুইনিপিয়াক ইউনিভার্সিটির এক জরিপে বলা হয়, ট্রাম্পের ভোটারদের ৬ শতাংশ তাঁকে ভোট না দিতে পারেন। তেমনটা হলে তাঁর জন্য লড়াইটা কঠিন হবে।
ফেডারেল আদালতে দোষী সাব্যস্ত (ফেডারেল অপরাধ) ব্যক্তিকে ক্ষমা করার ক্ষমতা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের। কিন্তু এই মামলা নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বিষয়। তাই ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিজেকে ক্ষমা (যদি দোষী সাব্যস্ত হন) করার এখতিয়ার তাঁর থাকবে না।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল বদলে ফেলার চেষ্টার অভিযোগে জর্জিয়ার আদালতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলছে। এই মামলার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
ফেডারেল মামলার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারেন কি না, তা নিয়ে সংবিধান–বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত আছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে একাধিক ফেডারেল মামলা আছে। এসব মামলার বিচার নভেম্বরের নির্বাচনের আগে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে যদি হয়ও, আর ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি এই চেষ্টাটি করতে পারেন। এমন ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র আগে কখনো ঘটেনি।