ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের তৈরি করা প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন ইসরায়েলের সমর্থকেরা
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলেসের (ইউসিএলএ) ক্যাম্পাসে ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের তৈরি করা প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন ইসরায়েলের সমর্থকেরা

গ্রেপ্তার ও সহিংসতা: যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিক্ষোভ কমার লক্ষণ নেই

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার রাতে নিউইয়র্কে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় ও ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভ প্রতিহতকারী ইসরায়েল–সমর্থকদের হামলার পরও আন্দোলনে ভাটা পড়ার কোনো লক্ষণ নেই।

নিউইয়র্কের পুলিশ বিভাগ বলেছে, মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার ভোর পর্যন্ত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কের ক্যাম্পাস থেকে তারা ২৮২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ধরপাকড়ের বড় ঘটনাটি ঘটে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যামিলটন হল দখল করে থাকা বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের পুলিশ উচ্ছেদ করতে গেলে। ফিলিস্তিনপন্থী এ বিক্ষোভকারীরা গত ৩০ এপ্রিল থেকে হলটি দখল করে ছিলেন।

ভবনটিকে ‘ম্যান্ডেলা হল’ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতার সমর্থনে ১৯৮৫ সালে হলটিতে একই রকমের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। বর্তমানে বিক্ষোভকারীরা হলটির নাম দিয়েছেন ‘হিন্দ’স হল’। ইসরায়েলের হামলায় সপরিবার নিহত ফিলিস্তিনের ৬ বছরের শিশু হিন্দ রাজাবের নামে এ নামকরণ করা হয়েছে।

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাংবাদিক মেঘনাদ বোস আল–জাজিরাকে বলেন, এ ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ যখন শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করে, তখন সেখানে ছিলেন তিনি। এর আগে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রবেশপথে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন, যাতে পুলিশ ভেতরে ঢুকতে না পারে।

এক্সে এক পোস্টে নিউইয়র্ক পুলিশের উপকমিশনার (অপারেশন) কেজ ডট্রি বলেন, ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুরোধ জানিয়েছিল তাঁদের। পরে পুলিশ ক্যাম্পাসে অবৈধ অস্থায়ী তাঁবুর শিবিরগুলো অপসারণ করে, বিভিন্ন ভবন দখল করে থাকা বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেয় এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।

তরুণদের মৌলবাদী করার আন্দোলন চলছে। আমি এর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি না।
—এরিক অ্যাডামস, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র

একই দিন রাতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া লস অ্যাঞ্জেলেসে (ইউসিএলএ) ফিলিস্তিনপন্থী শিক্ষার্থীদের শিবির গুঁড়িয়ে দেন ইসরায়েলের সমর্থকেরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর বিভিন্ন বস্তু ছুড়ে মারেন তাঁরা।
ইউসিএলএ ক্যাম্পাস থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিক সের্গিও ওলমস আল–জাজিরাকে বলেন, বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলায় তিনি কয়েক শ ইসরায়েল-সমর্থককে অংশ নিতে দেখেছেন। বিক্ষোভকারীদের লাঠিসোঁটা দিয়ে পেটান ও কয়েকটি ঘটনায় কাচের বোতল ছুড়ে মারেন তাঁরা।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, লস অ্যাঞ্জেলেসে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাতে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোকারীদের ওপর হামলা চালান ইসরায়েলের সমর্থকেরা

ইউসিএলএ ক্যাম্পাসে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করে পুলিশ। এক্সে এক পোস্টে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ বিভাগ বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ওই হস্তক্ষেপ করে তারা।

ইউসিএলএ থেকে অনুসন্ধানী সাংবাদিক সের্গিও ওলমস জানান, বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলায় তিনি কয়েক শ ইসরায়েল-সমর্থককে অংশ নিতে দেখেছেন। বিক্ষোভকারীদের লাঠিসোঁটা দিয়ে পেটান ও কয়েকটি ঘটনায় কাচের বোতল ছুড়ে মারেন তাঁরা।  

লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে আল–জাজিরার সংবাদদাতা রব রেনল্ডস বলেন, সহিংসতার পরও ক্যাম্পাসে তাঁবুর শিবিরগুলো রয়েছে। হামলা সত্ত্বেও সেখানে রয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা পালিয়ে যাননি।

চলছে বিক্ষোভ, পাল্টাপাল্টি সমালোচনা

গ্রেপ্তার-হামলা-সহিংসতার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলছে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ।

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর গাজায় শুরু করা ইসরায়েলি বাহিনীর তাণ্ডবে এ পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৫০০–এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকার বড় অংশ।

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রকে ‘গণহত্যা থেকে বিচ্ছিন্ন’ থাকার এবং ইসরায়েল ও দেশটিতে সরবরাহ করা অস্ত্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সুবিধা না নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন।    

সবশেষ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও সিটি কলেজ অব নিউইয়র্ক ছাড়াও আরও যেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটেছে, সেসবের মধ্যে রয়েছে নিউ অরলিন্সের টিউলেন বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ফ্লোরিডা ও ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন।

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেড়ে চলা বিক্ষোভে পুলিশ যেভাবে সাড়া দিচ্ছে, তাতে ক্ষোভ জানিয়েছেন দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড নিয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত (স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার) ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। গতকাল তিনি বলেন, একটি বিদেশি রাষ্ট্রের চালিয়ে যাওয়া গণহত্যার বিরুদ্ধে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শুরু হওয়া বিক্ষোভ দমনে পুলিশের সহিংস পদক্ষেপে তিনি আতঙ্কিত।

তবে বিক্ষোভকারীদের ওপর দমন–পীড়নকে দৃশ্যত সমর্থন করেছে হোয়াইট হাউস। চলমান বিক্ষোভকে ইহুদিবিরোধিতার সঙ্গে যুক্ত করেছে তারা।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোকারীদের তাঁবু ভাঙচুর করেন ইসরায়েলের সমর্থকেরা

হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র কারিন জ্যঁ-পিয়েরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘তাঁরা (বিক্ষোভকারীরা) শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত করতে পারেন না। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও অন্যান্য কমিউনিটির লোকজনের নিরাপদবোধ করার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’

ইউসিএলএ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের ওপর ইসরায়েল-সমর্থকদের হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে কারিন জ্যঁ-পিয়েরে নির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি বলেন, হোয়াইট হাউস সব ধরনের সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে।  
এদিকে ইউসিএলএর সহিংসতাকে ‘ঘৃণ্য ও অমার্জনীয়’ বলে মন্তব্য করেন লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র কারেন ব্যাস।

আর বিক্ষোভকারীদের দমনে পুলিশের নেওয়া পদক্ষেপ সমর্থন করেন নিউইয়র্ক সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস। তিনি দাবি করেন, ‘কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ব্যক্তিরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।’ অবশ্য পুলিশ তাঁর এমন দাবির পক্ষে কিছু বলেনি।

মেয়র আরও বলেন, ‘তরুণদের মৌলবাদী করার আন্দোলন চলছে। আমি এর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি না।’