হেনরি কিসিঞ্জারের লজ্জিত হওয়া উচিত

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯২৩ সালের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন তিনি
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের বড় অংশের চোখেই হেনরি কিসিঞ্জার একজন যুদ্ধাপরাধী। তবে এখনো যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকে ঘিরে থাকা ক্ষমতাবৃত্তের বন্ধুরা তাঁকে গণ্য করেন একজন যশস্বী বুদ্ধিজীবী হিসেবে।

২৭ মে ১০০ বছর পূর্ণ করলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার। তবে এ পর্যন্ত তাঁকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য বৈরী পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। যদিও এখন অনেক ভাষ্যকারই তাঁর ‘নিপীড়নমূলক ও প্রাণঘাতী কৃতকর্ম’ নিয়ে মুখ খুলছেন, তবে দশকের পর দশক ধরে তিনি রাজনীতি ও মিডিয়া মহলে উচ্চকিত প্রশংসাই পেয়ে আসছেন।

নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা এক ইহুদি শরণার্থী কিশোর বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। দুই প্রেসিডেন্ট—রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে কাজ করা কিসিঞ্জার এক অর্থে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়েই ওঠেন।

তরুণ কূটনীতি কিসিঞ্জার ‘নিক্সন প্রশাসনের যৌনতার প্রতীক’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন। তথ্যপ্রমাণ বলছে, ১৯৬৯ সালে ওয়াশিংটনে হোমরাচোমরা ব্যক্তিদের একটি পার্টিতে হাজির হন কিসিঞ্জার। তাঁর কাছে ছিল ‘টপ সিক্রেট’ বা সর্বাধিক গোপনীয় লেখা একটি খাম। পার্টিতে আগত অন্য অতিথিরা বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল দমন করতে পারছিলেন না। তাঁদের প্রশ্নের জবাবে কিসিঞ্জার ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, খামের ভেতর রয়েছে প্লেবয় ম্যাগাজিনের সর্বশেষ সংস্করণ। (মার্কিন প্রকাশক হিউ হাফনার পরে নিশ্চিত করেছিলেন, কিসিঞ্জার প্লেবয় ম্যাগাজিন বিনা পয়সায় পেতেন।)

আসলে ওই খামের ভেতর ছিল প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি বক্তব্যের খসড়া, যে বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি তাঁর বাস্তববাদী রাজনীতির সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী উদারনৈতিকতার সমর্থকদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন টেনেছিলেন। বলাই বাহুল্য, নিক্সনের ওই বক্তব্য পরে কুখ্যাতি পায়।

সত্যিকার অর্থে সর্বাধিক গোপনীয় কাজ করেন হেনরি কিসিঞ্জার গত শতকের সত্তরের দশকজুড়ে, অত্যন্ত কদর্যভাবে। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি লাওস ও কম্বোডিয়ায় অবৈধ বোমা হামলার ছক কষেন এবং তার বাস্তবায়নও করেন। পূর্ব তিমুর ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) গণহত্যার পথ সুগম করেন কিসিঞ্জার।

এরই মধ্যে কিসিঞ্জার পরিচিতি পান ‘পশ্চিমা অঙ্গনের প্লেবয়’ হিসেবে। তিনি ক্যামেরাবন্দী হতে পছন্দ করতেন। তাঁকে নিয়ে নানা কানাঘুষাও চলতে থাকে। সেই সময় এক মধ্যরাতে অভিনেত্রী জিল সেন্ট জনের হলিউডের বাসভবনে কিসিঞ্জারকে দেখা যায়। (পরে এর ব্যাখ্যায় কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমি তাঁকে দাবা খেলা শেখাচ্ছিলাম।’)

নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের দহরম-মহরম এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে রুশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ দার্শনিক ইসাইয়া বার্লিন তাঁদের ‘নিক্সনজার’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই ‘জুটি’ ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছাতে। উদারনৈতিক এলিটদের অবজ্ঞা করা ছিল তাঁদের লক্ষ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিষয়ক পাক্ষিক দ্য নেশন–এর প্রচ্ছদ

কিসিঞ্জার সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনকে হেয় করেছেন। আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেন অপমানজনক বিশেষণ—‘উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কলেজপড়ুয়া বাচ্চা’। নারীদেরও অপমান করেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘আমার কাছে নারী বিনোদনের বেশি কিছু নয়, একটা শখমাত্র। আর কেউ শখের পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করে না।’ তবে এত কিছুর পরও সমাজের উচ্চশ্রেণির কাছে কিসিঞ্জারের কদর ছিল।

এই কদরের ব্যাপ্তি সত্তরের দশকেই আটকে থাকেনি; ২০১৩ সালে যখন কিসিঞ্জার ৯০ বছর পূর্ণ করেন, তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হাজির হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—উভয় দলের কর্তাব্যক্তিরা। এই দলে ছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, সিনেটর জন ম্যাককেইনসহ প্রায় ৩০০ ভিআইপি। দুই দলের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখার প্রশ্নে কিসিঞ্জারের সুখ্যাতি আছে। (সন্ধ্যায় হয়তো রিপাবলিক কন্ডোলিৎজা রাইস ও ডোনাল্ড রামসফেল্ড গেলেন কিসিঞ্জারের কাছে, পরে রাতের দিকে সেখানে হাজির হলেন ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটন।)

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও হেনরি কিসিঞ্জার। ২০১৩ সালে এক অনুষ্ঠানে

তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বের বড় অংশই কিসিঞ্জারকে গালি দেয়। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ কয়েকটি দেশ এড়িয়ে চলেন এই ভয়ে যে তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হতে পারে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তোলা হতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০২ সালে চিলির একটি আদালত দেশটির সামরিক অভ্যুত্থানে (১৯৭৩) তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে জানতে কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর আগে ২০০১ সালে ফ্রান্সের একজন বিচারক প্যারিসে কিসিঞ্জারের হোটেল কক্ষে পুলিশ পাঠিয়েছিলেন। চিলির ওই অভ্যুত্থানের ব্যাপারে তাঁর কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল। ওই সামরিক অভ্যুত্থানের সময় বেশ কজন ফরাসি নাগরিক নিখোঁজ হন।

ওই একই সময়ে কিসিঞ্জার তাঁর পূর্বনির্ধারিত ব্রাজিল সফর বাতিল করেন। তখন এই জল্পনা ডানা মেলেছিল যে ব্রাজিলে তাঁকে আটক করা হতে পারে এবং ‘অপারেশন কন্ডোর’-এর ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালে লাতিন আমেরিকার একনায়কেরা যোগসাজশে তাঁদের বিরোধী নির্বাসিত নেতাদের গুম করার জন্য ওই অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনার একজন বিচারক এ ঘটনায় কিসিঞ্জারকে অন্যতম ‘আসামি বা সন্দেহভাজন’ বলেছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রে কিসিঞ্জার ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেখানে গত শতকের অন্যতম এই ‘কসাই’ ধনবান ও ক্ষমতাধরদের কাছে আদরণীয়, শ্রদ্ধাভাজন।

কেননা, কিসিঞ্জারের তত্ত্ব আজও সমানভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেটা হলো, যদি কোনো সার্বভৌম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো চলতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে ওয়াশিংটন দ্রুত ওই দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করতে উঠেপড়ে লেগে যাবে। হোয়াইট হাউস কোন দলের নিয়ন্ত্রণে, সেটা কোনো বিষয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রের এটাই স্বাভাবিক চরিত্র।

ফলে কিসিঞ্জার যত দিন জীবিত থাকবেন, তত দিন মার্কিন শাসনক্ষমতার বৃত্তে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যমণি হয়েই থাকবেন।

ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ হাসান ইমাম