দীর্ঘ ১৪ বছরের আইনি লড়াই শেষে আজ বুধবার মুক্তি মিলেছে উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের। যিনি অনেকের কাছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে অকুতোভয় এক যোদ্ধা।
আবার কারও কারও কাছে ৫২ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য নিয়ে বেপরোয়া কাজ করে বসা একজন, যিনি জনগণের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন।
২০১০ ও ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন সামরিক–কূটনৈতিক নথি ফাঁস করে বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন অ্যাসাঞ্জ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ফাঁস করা নথিগুলো রীতিমতো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
এ ঘটনায় অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা করে মার্কিন বিচার বিভাগ। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি যুক্তরাজ্যের কারাগারে আটক ছিলেন। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ থেকে বাঁচতে অ্যাসাঞ্জ সাত বছর যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডর দূতাবাসের আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে তাঁকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে লন্ডন পুলিশ। অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে সুইডেনে একটি ধর্ষণ মামলাও হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিলে ১৯৭১ সালে জন্ম হয় অ্যাসাঞ্জের। অনেকটা যাযাবরের মতো শৈশব কেটেছে তাঁর। মেলবোর্নে স্থায়ী হওয়ার আগে অন্তত ৩৭টি স্কুল পরিবর্তন করেছেন অ্যাসাঞ্জ।
কৈশোরে কম্পিউটার হ্যাকিংয়ে দারুণ দক্ষতা দেখাতে শুরু করেন অ্যাসাঞ্জ। যে কারণে অস্ট্রেলিয়া পুলিশের নজরদারিতেও পড়েন। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনত, সেগুলোর প্রায় সবই তিনি স্বীকার করে নিতেন এবং জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যেতেন।
একজন সমাজকর্মী ও আইটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ২০০৬ সালে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাসাঞ্জ।
২০১০ সালে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অ্যাসাঞ্জ বলেন, ‘আমরা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি নতুন মানদণ্ড তৈরি করছি।’
২০১০-২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন সামরিক-কূটনৈতিক নথি ফাঁস করার বছরই অ্যাসাঞ্জের আইনি লড়াই শুরু হয়। নথি ফাঁসের ঘটনার পরপরই তাঁর বিরুদ্ধে সুইডেনে ধর্ষণ মামলা করেন এক নারী। সে অভিযোগ অস্বীকার করেন অ্যাসাঞ্জ।
ধর্ষণ মামলার পর সুইডেন যখন প্রত্যর্পণের দাবি জানায়, তখন অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যে ছিলেন। প্রত্যর্পণ থেকে বাঁচতে তিনি ইকুয়েডর সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং ইকুয়েডর সরকার ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে লন্ডনে তাদের দূতাবাসে তাঁকে আশ্রয় দেয়।
২০১২ সাল থেকে টানা সাত বছর লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসের ভেতর একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করতেন অ্যাসাঞ্জ।
অ্যাসাঞ্জ সেখানে একটি ট্রেডমিলে দৌড়ে এবং একটি সান ল্যাম্প ব্যবহার করে দিনের আলোয় তাঁর বের হতে না পারার অভাব পূরণ করতেন। নিজের ওই অবস্থাকে তিনি মহাকাশে স্পেস স্টেশনে বসবাস করার সঙ্গে তুলনা করতেন।
ইকুয়েডরে সরকারের পালাবদল হলে নতুন সরকার ২০১৯ সালের এপ্রিলে অ্যাসাঞ্জকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে তুলে দেয়। জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে অ্যাসাঞ্জকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় লন্ডন পুলিশ।
২০১৯ সালে সুইডিশ সরকার অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে হওয়া ধর্ষণ মামলার তদন্ত বাতিল করে দেয়। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল, অভিযোগের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ থাকলেও বাদী নিজের অভিযোগের পক্ষে পুলিশি তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
ধর্ষণ মামলা থেকে রেহাই পেলেও মার্কিন গুপ্তচরবৃত্তি আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত তথ্য ফাঁসের ষড়যন্ত্র করার ১৮টি অভিযোগ এনে মামলা করে।
অ্যাসাঞ্জ পাঁচ বছর লন্ডনের উচ্চনিরাপত্তাসমৃদ্ধ বেলমার্শ কারাগারে বন্দী ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য সরকার। সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন অ্যাসাঞ্জের আইনজীবীরা। তখন তাঁরা বলেছিলেন যে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
অ্যাসাঞ্জকে আপিল করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে বিচারক বলেছিলেন, অনেক দিক বিবেচনায় প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে অ্যাসাঞ্জের আপিল করার সুযোগ রয়েছে।
কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকার প্রত্যর্পণে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আপিল আবেদন করতে যাওয়ার দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন অ্যাসাঞ্জ।
ওই চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁসের যে ফৌজদারি অভিযোগ অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, দেশটির কোনো আদালতের সামনে সেই দোষ তিনি স্বীকার করে নেবেন।
এই সমঝোতার মাধ্যমে গত সোমবার বেলমার্শ কারাগার থেকে ছাড়া পান অ্যাসাঞ্জ। এরপর তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের নর্দার্ন মারিয়ানা আইল্যান্ডসে রওনা দেন।
সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতে আজ বুধবার তিন ঘণ্টার শুনানিতে অংশ নেন অ্যাসাঞ্জ। সমঝোতা অনুযায়ী, আদালতে অ্যাসাঞ্জ ফৌজদারি অভিযোগের দোষ স্বীকার করেন।
প্রধান ডিস্ট্রিক্ট জজ রামনা ভি মাংলনা অ্যাসাঞ্জের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাজ্যে কারাভোগ করায় (৫ বছর ২ মাস) তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করেন মার্কিন আদালত।
অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করে তাঁর সমর্থকেরা। অ্যাসাঞ্জের এই সমর্থক দলে রয়েছেন চীনের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী আই ওয়েওয়ে ও প্রয়াত ফ্যাশন ডিজাইনার ভিভিয়েন ওয়েস্টউড।
অ্যাসাঞ্জ প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং যেসব পত্রিকা তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নথি ফাঁসে কাজ করেছে, তাদের সমর্থন পান।
তবে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ী করতে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে মার্কিন স্পেশাল প্রসিকিউটর রবার্ট মুলার দেখেছেন, রাশিয়া ‘খুব সম্ভবত’ ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রচার কার্যক্রম হ্যাক করেছিল এবং ‘উইকিলিকস’সহ বিভিন্ন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে প্রকাশ্যে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল।
দুই সন্তানের জনক অ্যাসাঞ্জের স্ত্রীর নাম স্টেলা। অ্যাসাঞ্জের মামলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আইনজীবী স্টেলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ২০২২ সালের মার্চে বেলমার্শ কারাগারে তাঁরা বিয়ে করেন।