চারটি ফৌজদারি মামলায় ট্রাম্প অভিযুক্ত। ফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টার মামলায় ২৫ আগস্ট তাঁকে জর্জিয়ার আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। এত কিছুর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে। তাঁকেই তাঁরা ভাবছেন ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের’ প্রতিভূ।
২০১৫ সালের কথা। ফ্যানি উইলিস তখন জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টার সহকারী ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি। স্থানীয় সরকারি স্কুলব্যবস্থায় সক্রিয় সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে মামলায় তিনি সরকারপক্ষের প্রধান আইনজীবী। এই শহরের এক দল শিক্ষক ও স্কুল প্রশাসক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার নম্বর নিয়ে ব্যবসার এক গোপন চক্র গড়ে তুলেছিলেন। অর্থের বিনিময়ে নম্বর বাড়ানোর ব্যবসা।
যে আইনের অধীনে ফ্যানি উইলিস এই প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন, সেটির নাম রিকো। ১৯৭০ সালে গৃহীত সেই আইনের লক্ষ্য ছিল, আমেরিকার শক্তিশালী মাফিয়া অপরাধী চক্রকে জালে ফেলা। এই রিকো আইন ব্যবহার করেই সে বছর ফ্যানি উইলিস আটলান্টার ১২ প্রতারক শিক্ষককে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।
২০২৩ সালে আরও বড়, আরও মারাত্মক এক অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন ফ্যানি উইলিস। এই চক্রের পালের গোদা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে নির্বাচনের ফল পাল্টে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে মেতেছিলেন তিনি। তিনি শুধু একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা ও ডজনখানেক আইনজীবী। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত কর্মকর্তা এবং রিপাবলিকান দলের কর্তাব্যক্তিরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গরাজ্য—যেসব রাজ্যে ট্রাম্প অল্পবিস্তর ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন—তার সবগুলোতেই প্রতারণার জাল বিছানো হয়েছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনা ছিল, যদি একটি রাজ্যেও জাল ভোটের অভিযোগ ধোপে টিকে যায়, তাহলে তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা অসম্ভব হবে না।
প্রায় আড়াই বছর তদন্তের পর সেই রিকো আইনের অধীনেই গত সপ্তাহে ফ্যানি উইলিস সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং তাঁর আরও ১৮ সহযোগীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও জালিয়াতির অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। আটলান্টার একটি জুরি দলের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আদালত ট্রাম্পসহ সব আসামিকে ২৫ আগস্ট দুপুরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন।
জর্জিয়ার এই মামলা হিসাব করলে এটি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চতুর্থ ফৌজদারি আরজি। এর আগে নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা ও ওয়াশিংটন ডিসিতে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত হয়ে এখন তিনি জামিনে রয়েছেন। নিউইয়র্কের মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আর্থিক প্রতারণার। ফ্লোরিডার মামলায় অভিযোগ রাষ্ট্রের অতিগোপনীয় নথি স্থানান্তরের। আর ওয়াশিংটন ডিসির মামলাটি ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা ঘিরে। এসব মামলার কোনোটিতে ট্রাম্প দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে ৫ থেকে ২০ বছর বা এর চেয়েও বেশি সময় জেলের ঘানি টানতে হবে।
অ্যাটর্নি ফ্যানি উইলিস ৯৮ পাতার যে অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন, তা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। ট্রাম্পের অধিকাংশ উপদেষ্টা ও হোয়াইট হাউসের আইনজীবীদের তাঁর হারের ব্যাপারে স্পষ্ট মতামত সত্ত্বেও তিনি যেকোনো উপায়ে—আইনসম্মত বা বেআইনি—যেভাবে হোক ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা চালান। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তিনি ৬১টি মামলা করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দৌড়ান। তবে প্রতিটি মামলায় ট্রাম্প পরাস্ত হন।
এরপরও ট্রাম্প থামেননি। অনুগত দু-চারজন আইনজীবীর পরামর্শে তিনি রিপাবলিকান অধ্যুষিত সাতটি অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্যদের দিয়ে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার তৎপরতা চালান। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ভোটের ভিন্ন হিসাব হাজির করে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে দিয়ে ৬ জানুয়ারি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যয়নের কাজটি বিলম্বিত করা। একবার এই প্রত্যয়নে বাধা দেওয়া গেলে ‘বাকিটা আমরা দেখে নেব,’—এ কথা তিনি পেন্সকে বলেছিলেন। কিন্তু পেন্স তাঁর কথায় একমত হননি।
যে সাতটি অঙ্গরাজ্যের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রতিটিতে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের চেয়ে সামান্য ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন। ফলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, পেছন থেকে ঘুঁটি চালিয়ে ভোটের হিসাবে বদলে দেওয়া যাবে। ট্রাম্প নিজে বার কয়েক ফোন করে রাজ্যপর্যায়ের আইন পরিষদের নেতাদের ফল পাল্টে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কয়েকজনকে উড়োজাহাজে করে হোয়াইট হাউস পর্যন্ত ডেকে আনেন। কোনোটিতেই কাজ হয়নি।
এই অপরাধকর্মে ট্রাম্পকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানি এবং আরও কয়েকজন আইনজীবী। তাঁরা গল্প ফেঁদে বসেন, ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্রে কারচুপির কারণে ভোটের হাতবদল হয়েছে। ইতালিতে বসে স্যাটেলাইটে ভোট চুরি করা হয়েছে, এমন কল্পকাহিনিও তাঁরা শোনান। জর্জিয়ার বেলায় তাঁরা আঙুল তোলেন দুই কৃষ্ণকায় নারী ভোটকর্মীর ওপর। তাঁরাই গোপনে হাজার হাজার নকল ভোট দিয়েছেন, এমন একটি ভিডিও দেখিয়ে তাঁরা ভোট জালিয়াতির প্রমাণ তুলে ধরেন।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সেই দুই নারী ভোটকর্মী একে অন্যের হাতে কিছু একটা তুলে দিলেন। জুলিয়ানির দাবি, অন্য কিছু নয়, হাতবদল হয়েছে কম্পিউটারের একটি মেমোরি কার্ড। তদন্ত শেষে দেখা গেল, নাহ্, সেই দুই কর্মী এক অন্যকে মিন্ট বা লজেন্স দিচ্ছেন।
পরে অবশ্য এই জুলিয়ানি স্বীকার করেছেন, ওই দুই কর্মীর ব্যাপারে তিনি মিথ্যা বলেছেন।
কোনো কিছুতেই যখন কিছু হলো না, তখন ট্রাম্প তাঁর শেষ অস্ত্রটি ছাড়লেন। তাঁর কথায় উৎসাহিত হয়ে হাজার হাজার দাঙ্গাবাজ ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলা চালাল। তিনি হোয়াইট হাউসে টিভির সামনে বসে সে ঘটনা দেখলেন। দাঙ্গা থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না।
নিউইয়র্ক ও জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য পর্যায়ের দুটি এবং ফেডারেল পর্যায়ের দুটি ফৌজদারি মামলার আসামি ট্রাম্প। ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় অন্য একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ৫০ লাখ ডলারের জরিমানা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৯১টি অপরাধের—আইনি ভাষায় ফেলোনির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিটির জন্য থাকছে অন্যূন পাঁচ বছরের জেল।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তা সত্ত্বেও দলীয় সমর্থকদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি। উল্টো প্রতিটি মামলার পর দেখা গেছে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেছে। এই জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে সাধারণ সমর্থকদের কাছ থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এই অর্থের একটা বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে মামলার কাজে।
ট্রাম্প এই মুহূর্তে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাছাই পর্যায়ে রিপাবলিকান দলের অন্য সব প্রার্থীর চেয়ে এগিয়ে। এমনকি জো বাইডেনের সঙ্গে সম্ভাব্য মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর সমর্থন সমানে সমান। অন্তত নিউইয়র্ক টাইমস–এর জনমত জরিপ তাই বলছে। এতে দুজনেরই ৪৩ শতাংশ করে জনসমর্থন দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এই মুহূর্তে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিভক্ত। এই বিভক্তি শুধু রিপাবলিকান বনাম ডেমোক্র্যাট নয়। অথবা ডান ও বামের আদর্শগত নয়। এই বিভক্তির মূলে রয়েছে বর্ণবাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, তাদের চিরাচরিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব হুমকির মুখে। আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে এ দেশের সংখ্যাগুরু জনসংখ্যা হবে অশ্বেতকায়।
আসলে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ধরলে যুক্তরাষ্ট্র এখনই অশ্বেতকায়-প্রধান (মাইনরিটি মেজরিটি)। এই হুমকি কোনো তাত্ত্বিক ব্যাপার নয়, বাস্তব। শ্বেতাঙ্গরা ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে ঠাহর করেছেন ২০০৮ সালে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর। ওবামার নির্বাচনী বিজয়কে যখন বর্ণবাদ-উত্তর আমেরিকার সম্ভাব্য ছবি হিসেবে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি, তখন রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবেশের পাঁয়তারা করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্রুত তিনি হয়ে উঠবেন নয়া শ্বেত জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে কট্টর মুখপাত্র। তাঁর প্রধান অস্ত্র শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ, বহিরাগতদের প্রতি ঘৃণা ও খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ।
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, নারী অধিকারের বিস্তৃতি ও অব্যাহত অভিবাসনপ্রক্রিয়ার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এখন দুই স্পষ্ট শিবিরে বিভক্ত। একদিকে মুখ্যত শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও অতি রক্ষণশীল রিপাবলিকান, যাঁদের অধিকাংশ কৃষিপ্রধান অঞ্চলের বাসিন্দা, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ও খ্রিষ্টীয় চেতনায় সঞ্জীবিত। অন্যদিকে প্রধানত শহুরে এবং কলেজশিক্ষিত ডেমোক্র্যাট, যাঁদের এক বড় অংশ অশ্বেতকায়, বহিরাগত ও শহুরে নারী। এই দুই শিবিরের মধ্যে বিভক্তি যেমন রাজনৈতিক, তেমনি তা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা প্রভাবিত।
শ্বেত জাতীয়তাবাদের ভয়, আমেরিকায় তাঁরা দীর্ঘদিন যে রক্ষণশীল মূল্যবোধকে লালন করছেন, শহুরে ‘অভিজাত’ সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রভাবে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। কারিগরি ও প্রযুক্তিগত বিবর্তন ও বিশ্বায়নের প্রভাবে প্রথাগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ কমে আসছে। যাঁরা যুগ যুগ ধরে কয়লাখনি অথবা কায়িক শ্রমনির্ভর উৎপাদন খাতে কাজ করে এসেছেন, তাঁরা বিপদে পড়ে গেছেন। পরিবর্তন মেনে নেওয়ার বদলে এই অবস্থার জন্য তাঁরা সব দোষ চাপাচ্ছেন উদারপন্থী ডেমোক্র্যাটদের ওপর।
এই অসন্তুষ্ট জনগোষ্ঠীর মুখপাত্র হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি একটি অতিরক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের গুরু। কারও কারও ভাষায় তিনি একজন ‘কাল্ট লিডার’। শত অপরাধ করলেও তাঁর প্রতি আনুগত্য কমবে না। চার ফৌজদারি মামলার পরও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা তাঁর সে কথাই প্রমাণ করে।
ট্রাম্প হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের চলতি সংকটের দৃশ্যমান প্রতিনিধি ও কণ্ঠস্বর। তবে তিনি এই অসুখের কারণ নন। যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জনসংখ্যাগত ব্যবধান এই দেশকে দুই শিবিরে বিভক্ত করেছে—এমন কোনো জাদুদণ্ড নেই, যা ঘোরালে এই ব্যবধান ঘুচে যাবে। বরং ভবিষ্যতে এই উত্তেজনা ও বৈরিতা আরও বাড়বে। কেউ কেউ বলছেন, চলতি বিভক্তির কারণে অদূর ভবিষ্যতে দেশটি আরেক গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে দেশের উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, তা আপাতদৃষ্টে দাসপ্রথা ঘিরে হলেও আদতে লড়াইটা ছিল ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে। উদারপন্থী ও নগরপ্রধান উত্তর তাতে জয়ী হয়েছিল। পরাজিত দক্ষিণ সে বিপর্যয়ের ক্ষত এখনো শুশ্রূষা করে যাচ্ছে।
একজন সিপাহসালারের অপেক্ষায় ছিলেন আমেরিকার শ্বেতকায় মানুষ। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁদের সেই সিপাহসালার।
হাসান ফেরদৌস লেখক ও প্রাবন্ধিক