‘আমি তাঁকে বাসার বাইরে রাখতে পারি না’, মজা করে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক সম্পর্কে এ কথা বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্প্রতি ফ্লোরিডায় পাম বিচে নিজ বাসভবন ‘মার-এ-লাগো’–তে মজা করার সময় ট্রাম্প আরও বলেন, ‘তাঁর (মাস্ক) এখানে থাকাটা আমি উপভোগ করি। তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। তিনি অবিশ্বাস্য একজন মানুষ।’
কিন্তু দুজনের এই উষ্ণ সম্পর্ক কত দিন থাকবে? কারণ তাঁদের নীতিগত বিষয়ে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া দুজনই কিছুটা অস্থিরচিত্তের। বার্তা সংস্থা এএফপি ট্রাম্প ও মাস্কের মধ্যে সম্ভাব্য মতানৈক্যের ছয়টি বিষয় তুলে ধরেছে:
বস কে?
মাস্ক তাঁর পাগলাটে অভ্যাসের জন্য বিখ্যাত। নিজের কাজের ধরনকে তিনি নিজেই হার্ডকোর বা কঠোর বলে থাকেন। নিজের কোম্পানিগুলোকে তিনি ব্যক্তিগত জমিদারির মতো ব্যবহার করেন, যেখানে তাঁর কর্তৃত্বকে সাধারণত কেউ চ্যালেঞ্জই করতে পারেন না।
কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ থেকে শুরু করে দাপ্তরিক বৈঠক—সবখানেই মাস্ককে একই মেজাজে দেখা যায়। তাঁকে কর্মীদের বিনা নোটিশেই চাকরিচ্যুত করতে এবং সবার সামনেই বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অপমান করতে দেখা গেছে।
ট্রাম্পও নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হুটহাট করে কর্মী ছাঁটাই করেন। সবার সামনেই কর্মীদের অপমান করে থাকেন। কর্মীদের সম্পূর্ণ আনুগত্য চান তিনি। তা ছাড়া তাঁকে অতীতে অন্যদের সঙ্গে খ্যাতির ছটা ভাগাভাগি করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
ট্রাম্পের সাবেক সহযোগীরা বলেছেন, তিনি তাঁর উপদেষ্টা ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম অ্যাক্সিওসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বরিস এপস্টেইনের সঙ্গে ইলন মাস্ক কথা-কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তখন ঘটনাস্থলে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ ও আর্থিক সংস্থা ক্যান্টর ফিটজেরাল্ডের প্রধান নির্বাহী হাওয়ার্ড লাটনিককে অর্থমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিতে সবার সামনেই সুপারিশ করেন মাস্ক। লাটনিককে এ পদে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প। এতে করে ট্রাম্পের ওপর মাস্কের প্রভাব কতটা গভীর, সেটাই তুলে ধরে।
জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বর্তমানে যতটা সচেতনতা বেড়েছে, ২০০৪ সালে তেমনটি ছিল না। তখন এ বিষয়টি না ভেবেই বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানি টেসলায় বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন মাস্ক।
প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ২০১৭ সালে মাস্ককে নিজের ব্যবসা–বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদে রেখেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা-বিষয়ক প্যারিস চুক্তি-২০১৫ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিবাদে মাস্ক ওই পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
ওই সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে (এক্স) মাস্ক লিখেছিলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন প্রকৃত বিষয়। প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়াটা আমেরিকা বা বিশ্ব কারও জন্যই ভালো নয়।’
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে ‘ধাপ্পাবাজি’ বলে মনে করেন ট্রাম্প। তিনি প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিলেও ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাতে পুনরায় যুক্ত হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সম্প্রতি নিজের অবস্থানে পরিবর্তন এনেছেন মাস্ক। গত আগস্টে এক্স হ্যান্ডলে ট্রাম্পের সঙ্গে এক সরাসরি আলোচনায় মাস্ক বলেছেন, ‘এখন থেকে ৫০-১০০ বছর যদি আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে টেকসই থাকতে পারি, তাহলে আমি মনে করি সেটা সম্ভবত ঠিক আছে।’
বিশ্বের শীর্ষ জলবায়ুবিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত জাতিসংঘের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তাতে বিশ্বের গড় উষ্ণতা ২০৩০-এর দশকের শুরুর দিকে শিল্পবিপ্লবের আগের তুলনায় বেড়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, চলতি শতাব্দীতে বিশ্বের গড় উষ্ণতা এতটা বেড়ে গেলে, তা বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ ফল বয়ে আনবে।
জ্বালানি রূপান্তর
জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে মাস্কের কোম্পানিগুলো নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নিজের বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি টেসলায় বড় বিনিয়োগ করে তিনি এরই মধ্যে বিপুল অর্থ আয় করেছেন। অন্যদিকে তিনি ব্যাটারি প্রযুক্তি ও সৌরবিদ্যুৎ–চালিত ছাদ-টাইলস তৈরিতেও অর্থ বিনিয়োগ করছেন।
কিন্তু ট্রাম্পের নীতি এ ক্ষেত্রে উল্টো। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নতুন জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য তেল ও গ্যাসকূপ খননের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ড্রিল, বেবি, ড্রিল’। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসন নতুন জীবাশ্ম জ্বালানির অবকাঠামো তৈরির অনুমোদন দিতে পারেন। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত ভূমিতেও তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোকে কাজের অনুমতি দিতে পারেন।
জীবাশ্ম জ্বালানির প্রতি ট্রাম্পের ঝোঁককে ‘খনি খনন ও কয়লা পোড়ানো হাইড্রোকার্বন অর্থনীতি’ বলে ঠাট্টা করেছেন মাস্ক।
ট্রাম্প জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে ক্রিস রাইটকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি রূপান্তরের (এনার্জি ট্রানজিশন) কোনো ভিত্তি নেই। গত বছর প্রকাশ্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
চীন
ট্রাম্প চীনের বিষয়ে কঠোর। গত আমলের মতো ট্রাম্পের এ আমলেও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা রয়েছে। এমনটি হলে তা মাস্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের দোলাচল তৈরি করতে পারে।
কারণ, চীন টেসলার একটি বড় বাজার। দেশটিতে মাস্কের এ বৈদ্যুতিক গাড়ি কোম্পানির তথাকথিত ‘গিগাফ্যাক্টরি’ রয়েছে। চীনের দ্রুত বিকাশমান স্থানীয় বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে টেসলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেষ্টা করছে।
মাস্ক চীনের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে কখনো কোনো নেতিবাচক কথা বলেননি। কিন্তু ট্রাম্প চীনের বিষয়ে কঠোর মনোভাব পোষণকারী সিনেটর মার্কো রুবিওকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটা নিয়ে ট্রাম্প-মাস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে পারে।
ব্যয় কমানো
নিজের কোম্পানির ব্যয় কমানোর জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে নানা সময়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন ইলন মাস্ক। সম্ভবত এসব বিবেচনা থেকে নিজ প্রশাসনের ব্যয় কমানোর জন্য তাঁকে ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিশিয়েন্সি (ডোজ) নামের একটি নতুন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
ধারণা করা হচ্ছে, সরকারি কর্মসূচি সংকোচন করতে গিয়ে মাস্ক নিশ্চিতভাবে বড় ধরনের রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়বেন। এমনকি রিপাবলিকান রাজনীতিবিদেরাও তাঁর ব্যয় কমানোর নানা প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেন।
আগামী দুই বছরের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে দেশটির দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা (মেডিকএইড কর্মসূচি) ও প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলো কাদের হাতে যাচ্ছে, তা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতিতে মাস্কের ব্যয় কমানোর বিষয়টি ট্রাম্পের রাজনৈতিক অগ্রাধিকার হিসেবে গৌণ হয়ে পড়তে পারে।
বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি
সিলিকন ভ্যালির বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কয়েক দশক ধরে মাস্কের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের অংশ হিসেবে তিনি অজস্র স্বার্থের সংঘাতের মুখোমুখি হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প যদি মাইক্রোসফটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক কোম্পানি ওপেনএআইকে সহায়তা দেন, তাহলে মাস্ক কি তা নীরবে মেনে নেবেন? কারণ, মাস্কের নিজস্ব এআই কোম্পানি রয়েছে।
অথবা ট্রাম্প যদি ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের কথা শোনেন, মাস্ক তা কীভাবে নেবেন? মাস্কের মহাকাশ প্রযুক্তিবিষয়ক কোম্পানি ‘স্পেসএক্সের’ মতো বেজোসেরও একই ধরনের কোম্পানি রয়েছে। তাই ভবিষ্যতে বেজোসও যদি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন, সে ক্ষেত্রে মাস্কের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা হবে দেখার মতো বিষয়।