যুক্তরাষ্ট্র যেসব সামরিক জোটে রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ন্যাটো। ৭৪ বছর আগে গড়ে ওঠা এই জোটের সদস্য আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পারের দেশগুলো। জোটে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তবে এই ন্যাটো নিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ নাখোশ।
২০০০ সালে ট্রাম্পের একটি বই প্রকাশ পায়। ‘দ্য আমেরিকা উই ডিজার্ভ’ নামে ওই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘ইউরোপ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলে প্রতিবছর এই দেশের (যুক্তরাষ্ট্রের) লাখ লাখ ডলার বেঁচে যাবে।’ এমনকি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহারের হুমকিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করলে সেই ঘাটতি পূরণের সক্ষমতা নেই ইউরোপের।
আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে আবার লড়তে পারেন ট্রাম্প। এর আগে ট্রাম্পের প্রচার-প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা একটি ওয়েবসাইটে তিনি বলেছেন, ‘ন্যাটোর উদ্দেশ্য ও অভিযানগুলো গোড়া থেকে যে পুনর্মূল্যায়ন কাজ আমার প্রশাসনের আমলে হাতে নিয়েছিলাম, তা শেষ করতে হবে।’
ওয়েবসাইটে ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তিনি বা তাঁর দলের লোকজনও এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে বক্তব্যটি ঘিরে ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে।
ইউরোপে শান্তি বজায় রাখতে এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সুরক্ষিত থাকতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যাটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন) গড়ে তোলা হয়েছিল। এর মূল উদ্দেশ্যটি ‘পঞ্চম অনুচ্ছেদ’ নামে পরিচিত। তাতে বলা হয়েছে, ন্যাটোর কোনো সদস্যের ওপর সামরিক হামলা হলে সেটাকে পুরো জোটের ওপর হামলা হিসেবে দেখা হবে। ওই উদ্দেশ্য সামনে রেখে এখনো কাজ করে যাচ্ছে ন্যাটো।
ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প কী চান, তা জানতে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে যোগাযোগ করছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সদস্যরা। এ নিয়ে জানাশোনা আছে, এমন দুজন জানিয়েছেন, ওয়াশিংটনে নিয়োজিত ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মিক্কো হাউতালা সরাসরি ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেছেন। ন্যাটোর নতুন সদস্য হিসেবে তাঁর দেশ কতটা মূল্য রাখে, তা বোঝাতে চেয়েছেন।
ন্যাটো ইস্যু নিয়ে বিগত কয়েক মাসে নিউইয়র্ক টাইমসের কথা হয়েছে সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় কূটনীতিকের সঙ্গে। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও সরকার বড় শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। তাদের ধারণা, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে শুধু ইউক্রেনেই মার্কিন সহায়তা বন্ধ হবে না, আরও বৃহৎ পরিসরে ইউরোপ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে ন্যাটো থেকেও নিজেদের গুটিয়ে নেবে তারা।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সাবেক সেনা কর্মকর্তা জেমস জি স্টাভ্রিডিস বলেছেন, ইউরোপের দেশগুলো বড় যে ভয় পাচ্ছে, তা হলো দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে সত্যিকার অর্থে ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করা হবে। আর তা হবে ওয়াশিংটনের দিক দিয়ে বিশাল এক কৌশলগত ও ঐতিহাসিক ব্যর্থতা।
দ্য টাইমসকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সবার আগে রাখাটাই সব সময় আমার অগ্রাধিকারে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।’
২০২৫ সালে ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় এলে অবশ্যম্ভাবী একটি বিষয় হবে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনের পাশে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সংকট তৈরি। বর্তমানে ন্যাটোর বড় একটি লক্ষ্য হলো রুশ অভিযানের মুখে কিয়েভকে রক্ষা করা। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তবে দেশটি যে এখনো স্বাধীন, তার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ন্যাটোর।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বিনিয়োগ–সংক্রান্ত বিভাগের সহকারী মহাসচিব ছিলেন ক্যামিলি গ্রান্ড। তিনি বলেন, ট্রাম্পের ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে থাকবে কি থাকবে না, তা প্রথমত ইউক্রেন নিয়ে ট্রাম্পের পদক্ষেপের মাধ্যমেই যাচাই করতে পারবে ইউরোপের দেশগুলো।
ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারবেন। এটা তিনি কীভাবে করবেন, তা কখনো খোলাসা করেননি। তবে অনেকের দাবি, ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল রাশিয়া দখল করে রেখেছে, সেগুলো মস্কোর হাতে তুলে দেওয়ার বিনিময়ে হয়তো ট্রাম্প যুদ্ধ থামাতে চাইবেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বহুবার বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের বিনিময়ে তিনি কখনোই নিজেদের ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে সমর্পণ করবেন না। তবে ইউক্রেন সরকারের ওপর ট্রাম্পের অনেক কর্তৃত্ব থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই কিয়েভকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে। ইউরোপের দেশগুলোও দেশটিকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা বন্ধ করলে সেই ঘাটতি পূরণের সক্ষমতা নেই ইউরোপের।
মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পের অনেক মিত্রই রয়েছেন, যাঁরা তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি অনুসরণ করেন। ইতিমধ্যেই তাঁরা কিয়েভে আরও সামরিক সহায়তা পাঠানোর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। গত সপ্তাহে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে যুদ্ধরত ইউক্রেন ও ইসরায়েলের সহায়তার নতুন একটি তহবিল আটকে দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্প একটি বিষয়ে বড়াই করেন যে তিনি নাকি গোপনে ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর নেতাদের বলেছেন, রাশিয়া যদি তাদের ওপর হামলা চালায় আর তারা যদি ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের পাওনা অর্থ পরিশোধ না করে, তাহলে তিনি (ট্রাম্প) ওই দেশগুলোর সুরক্ষায় এগিয়ে আসবেন না।
‘ন্যাটোর উদ্দেশ্য ও অভিযানগুলো পুনর্মূল্যায়ন কাজ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তা ট্রাম্পের কাছে জানতে চেয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস। তিনি জবাবে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা যেন মার্কিনদের সুরক্ষায় কাজ করে এবং তাঁদের সম্পদ যেন বেপরোয়াভাবে ঝুঁকির মুখে না ফেলে, তা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
তবে ন্যাটোপন্থী ট্রাম্পের কয়েকজন সমর্থক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে সামরিক জোটটি থেকে সরিয়ে নেওয়ার ধোঁয়া তুলে তিনি আসলে ছলচাতুরী করছেন। তাঁরা বলেছেন, ট্রাম্প আসলে ইউরোপের ন্যাটো সদস্যদেশগুলোর ওপরে চাপ দিতে চাইছেন যেন দেশগুলো নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য আরও অর্থ খরচ করে।
ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনার বিষয়ে ট্রাম্পের সমর্থক ও সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) এটা করবেন না। তবে তিনি যেটি করবেন, তা হলো মানুষকে (ইউরোপের দেশ) আরও অর্থ দিতে বাধ্য করবেন। আর আমি মনে করি, এই কৌশলকে অনেকেই স্বাগত জানাবেন।’
একই কথা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা রবার্ট ও’ব্রিয়েনের। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ন্যাটোর সামরিক গুরুত্ব যে কতটা, তা ট্রাম্প বোঝেন। তবে তিনি মনে করেন, জার্মানিসহ অন্য দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা খাতের জন্য ন্যায্য অংশ খরচ না করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে খেলছে।
তবে ভিন্নমত ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা জন বোল্টনের। এক সাক্ষাৎকারে তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে ট্রাম্প ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন।’
ট্রাম্প যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, তখন তিনি এমন একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠীর সমর্থন পাবেন, যাদের যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের এবং বিদেশে ওয়াশিংটনের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বেশ সংশয় রয়েছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর রিনিউয়িং আমেরিকা’। ট্রাম্প–সংশ্লিষ্ট এই গবেষণাপ্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ন্যাটোয় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমানোর পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছিল।
১ নভেম্বর ‘হ্যারিটেজ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি রক্ষণশীল গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সফরে গিয়েছিল ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের একটি প্রতিনিধিদল। হ্যারিটেজ ফাউন্ডেশন ট্রাম্প সমর্থকদের মতোই ইউক্রেনে মার্কিন সহায়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধিতা করেছে।
ওই সফরে ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রতিনিধিরা মতবিনিময় করেছিলেন ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কর্মকর্তা মাইকেল অ্যান্টন, সেন্টার ফর রিনিউয়িং আমেরিকার কর্মকর্তা ড্যান কোল্ডওয়েল এবং ট্রাম্পপন্থী কয়েকজন সিনেটর ও সরকারি কর্মকর্তা।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া দুজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাইকেল অ্যান্টন সফররত ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের বলেছিলেন, কল্পনায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন, ট্রাম্প একটি আলটিমেটাম দিচ্ছেন যে নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার আগে ন্যাটো সদস্যরা যদি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণ না বাড়ায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সবার আগে রাখাটাই সব সময় আমার অগ্রাধিকারে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা হলো, আমাদের দেশের প্রতিরক্ষা, সীমান্ত, মূল্যবোধ, জনগণ এবং তাঁদের কাজকর্ম ও ভালো থাকাটা।’