কোস্টারিকার তারকোলেস নদীতে ভাসছে একটি আমেরিকান কুমির
কোস্টারিকার তারকোলেস নদীতে ভাসছে একটি আমেরিকান কুমির

সঙ্গী ছাড়াই কিছু প্রাণীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণ জানালেন বিজ্ঞানীরা

প্রাণিকুলে সঙ্গী ছাড়া একা মা হওয়ার মতো বিস্ময়কর ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে একটি শাপলাপাতা মাছের পেটে ডিম পাওয়া গেছে। তবে মাছটির কোনো সঙ্গী ছিল না। নর্থ হেনডারসনভিল এলাকার অ্যাকুয়ারিয়ামে জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে শার্লট নামের এই মাছ। গত আট বছরে মাছটি তার প্রজাতির কোনো ছেলে সঙ্গীর সঙ্গে মেশেনি। তারপরও রহস্যজনকভাবে মাছটির পেটে ডিম পাওয়া গেছে। এতে বিস্মিত হয়েছেন ওই অ্যাকুয়ারিয়াম ও শার্ক ল্যাবের বিজ্ঞানীরা।

এ ছাড়া গত বছর কোস্টারিকায় ১৬ বছর ধরে নিঃসঙ্গ কোকিতা নামের এক মেয়ে কুমির ডিম দিয়েছে। সেটি থেকে বাচ্চাও হয়েছে। এ ঘটনা ঘিরেও রহস্য তৈরি হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানুষের কাছে বিষয়টি উদ্ভট ঠেকলেও প্রাণিজগতে যৌনসংসর্গ ছাড়া এ ধরনের প্রজননের ঘটনা অপরিচিত নয়।

কোস্টারিকার ‘পারকে রেপতিলাঁদিয়া’ চিড়িয়াখানায় কুমিরটি ১৬ বছর ধরে সঙ্গীহীন ছিল। এর মধ্যেই ২০১৮ সালে কোকিতা কিছু ডিম পেড়েছিল। পরে দেখা যায়, একটি ডিমে কুমিরের পরিণত ভ্রূণ আছে। এত দিন নিঃসঙ্গ থাকা কুমিরটির ছেলে সঙ্গীর সংস্পর্শে আসার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এরপরও তার ডিমে পরিণত ভ্রূণ পাওয়ার ঘটনাটি রহস্যের জন্ম দেয়।

শাপলাপাতা মাছের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পাখনা তত্ত্বের কথা বলছেন। তাঁরা বলছেন, শার্লটের পাখনায় দুটি সাদা দাগ আছে, যা নির্দেশ করে, ট্যাংকে থাকা কোনো হাঙর শার্লটের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। কারণ, শার্লটের শরীরে কিছু সন্দেহজনক কামড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ধরনের চিহ্ন হাঙরের যৌনতার আচরণের একটি চিহ্ন হতে পারে।

তবে এটি হবে একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। কারণ, এতে হাঙর-শাপলাপাতা মাছের হাইব্রিড সৃষ্টি হবে। এর তত্ত্বের পরিবর্তে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এটি যৌনসংসর্গ ছাড়া (পার্থেনোজেনেসিস) নিষিক্ত ডিম থেকে বংশবৃদ্ধির বিরল ঘটনার ফলাফল হতে পারে। গ্রিক শব্দ পার্থেনোসের অর্থ ‘কুমারী’ ও জেনেসিস অর্থ ‘সৃষ্টি’। এ প্রক্রিয়ায় একটি ডিম্বাণু শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত না হয়ে একটি ভ্রূণে বিকশিত হয়। এখানে সঙ্গীর কোনো ভূমিকা থাকে না।

গত ৭ জুন বায়োলজি লেটারস নামের সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো এর কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁরা মনে করেন, আরও কিছু প্রাণীর মতো কুমিরও পার্থেনোজেনেসিস (যৌনসংসর্গ ছাড়া জন্মদান) ধরনের মাধ্যমে প্রজননে সক্ষম।

পার্থেনোজেনেসিস পোকামাকড়ের মধ্যে বেশ সাধারণ ঘটনা, যেমন মাছি। তবে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে পার্থেনোজেনেসিস বিরল। ২০০১ সালে একটি বন্দী বনেটহেড হাঙর প্রথম এ প্রক্রিয়ায় জন্ম দেয়। এর পর থেকে হাঙর ও সরীসৃপের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বেশি ঘটনা ঘটেছে।

পার্থেনোজেনেসিস ঠিক কেন ঘটে, তা এখনো রহস্য থেকে গেছে। কিছু কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, এটি মেয়ে প্রাণীর প্রজননের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়ার শেষ প্রচেষ্টা।

আণবিক জীববিজ্ঞানী কেভিন ফেল্ডহেম শিকাগোর ফিল্ড মিউজিয়ামে হাঙরের জনসংখ্যা ও যৌনতার আচরণ অধ্যয়নের জন্য জেনেটিকস ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, বিবর্তনের লক্ষ্য হলো জিনগুলোকে ছেড়ে দেওয়া। ছেলে প্রাণী থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো মেয়ে প্রাণী যৌন প্রজননের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম দেবে, সে সুযোগ নেই।

২০০৮ সালে ফেল্ডহেম শিকাগোর শেড অ্যাকুয়ারিয়ামে জেব্রা হাঙরদের মধ্যে পার্থেনোজেনেসিসের একটি ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। প্রথমত, তাঁকে অ্যাকুয়ারিয়ামের প্রাণীদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনার সম্ভাবনা বাতিল করতে হয়েছিল।

ফেল্ডহেম বলেন, ‘ওই মেয়ে প্রাণীর সঙ্গে কোনো ছেলে প্রাণীর যৌনতার কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল না। তবে ওই ট্যাঙ্কে ক্যামেরাও ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, হাঙরের পিতৃত্ব খুঁজে বের করা খুব জটিল হতে পারে। কারণ, কিছু কিছু স্ত্রী হাঙর যৌনতার পর কয়েক মাস পর্যন্ত শুক্রাণু সঞ্চয় করতে পারে।

তাহলে জেব্রা হাঙরের ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? এর উত্তরে ফেল্ডহেম বলেছেন, পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে।

প্রাণী প্রজননের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডিমগুলো মিয়োসিস নামক একটি প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়। যেখানে কোষগুলো বিভক্ত হয়, জেনেটিক উপাদান এবং তাদের মধ্যে অন্যান্য সেলুলার প্রক্রিয়া ভাগ হয়ে যায়। এ প্রক্রিয়া পোলার বডি তৈরি করে। সাধারণত, এই পোলার বডিগুলো মেয়ে প্রাণীরা পুনঃশোষণ করে। তবে পার্থেনোজেনেসিস যৌন প্রজনন অনুকরণের মাধ্যমে এই পোলার বডিগুলোর মধ্যে একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে এবং একটি কার্যকর ভ্রূণ গঠন করতে পারে।

তবে জর্জিয়া অ্যাকুয়ারিয়ামে হাঙর, স্কেট ও রশ্মি নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানী ক্যাডি লিয়ন বলেছেন, এটি ক্লোনিংয়ের জন্য একটি ভিন্ন প্রক্রিয়া। তবে এতে ত্রুটি আছে।

ক্যাডি লিয়ন বলেন, ‘এতে যে কোষগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, তা মায়ের কার্বন কপি নয়। যেহেতু ডিম ও পোলার বডি উভয়ই মায়ের জিনোমের অংশগুলো ধারণ করে, এ কারণে সন্তানেরা তাদের মায়ের চেয়ে কম জেনেটিক্যালি বৈচিত্র্যময় হয়।’

কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে অযৌন প্রজনন বেশ সুবিধার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মেক্সিকো ও ক্যালিফোর্নিয়ায় হুইপটেল টিকটিকির অধিকাংশই মেয়ে প্রজাতির। তারা অযৌনভাবে প্রজনন করে। এই প্রজাতি অযৌনভাবে প্রজননকারী মেয়ে টিকটিকির ডিমে ক্রোমোজোমের সংখ্যা দ্বিগুণ করে পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে তার জেনেটিক বৈচিত্র্য বজায় রাখার একটি অস্বাভাবিক উপায় বের করেছে। এর কিছু সুবিধা আছে, যা এই প্রজাতিকে নতুন এলাকায় বসতি গড়তে সাহায্য করে এবং যৌনবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করে।

অ্যাকুয়ারিয়ামে সেই শাপলাপাতা মাছ শার্লট

তবে এর কিছু ক্ষতিকর দিক আছে। প্রাকৃতিকভাবে সঙ্গী পছন্দের বিষয় না থাকায় এ প্রক্রিয়ায় তাদের ডিএনএ যৌন প্রজননের চেয়ে পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে বেশি ক্ষতিকারক জেনেটিক মিউটেশন গ্রহণ করে।

ফেল্ডহেম বলেছেন, সব প্রজাতি হুইপটেল টিকটিকির মতো পার্থেনোজেনেসিসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না। হাঙরের পার্থেনোজেনেসিসের বংশধরেরা স্বল্পস্থায়ী হয়, তারা খুব কমই যৌন পরিপক্বতায় পৌঁছায়।

বিজ্ঞানীরা যৌনতার মাধ্যমে জন্ম হওয়া ও পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে জন্ম হওয়া প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা গবেষণা করেন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পার্থেনোটস (পার্থেনোজেনেসিসের মাধ্যমে জন্ম) গড়ে এক বছর কম বেঁচে থাকে। এসব প্রাণী এমন আচরণ করে, যা তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দেয়; যেমন একমুখী সাঁতার, ঘোরানো, হেডস্ট্যান্ড ও খাওয়ানোর অসুবিধা।

এই গবেষক দলে ক্যাডি লিয়নও ছিলেন। তিনি বলেন, তিনি শাপলাপাতা মাছের ক্ষেত্রে পার্থেনোজেনেসিসের প্রমাণ দেখে আশ্চর্য হননি; যদিও শার্লটের বিষয়টি এ ঘটনাকে ঘিরে থাকা সব রহস্যের সমাধান করতে পারেনি।

প্রাণীদের ‘ভার্জিন বার্থ’-এর ইতিহাস
এক শতাব্দীর বেশি সময় আগে থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন, কিছু প্রাণী সঙ্গীর সঙ্গে যৌনসংসর্গ ছাড়াই প্রজননযোগ্য ডিম দিতে সক্ষম। এক দশকের বেশি সময় ধরে পার্থেনোজেনেসিস নিয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ওয়ারেন বুথ। তিনি বলেন, সর্বপ্রথম বিজ্ঞানীরা কবুতরের মধ্যে এমনটা আবিষ্কার করেন।

পরে সাপসহ আরও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে পার্থেনোজেনেসিসের উপস্থিতি দেখা গেছে। পাখি, টিকটিকি, কচ্ছপ ও হাঙরের মধ্যেও এ ধরনের প্রজননসক্ষমতা দেখা গেছে। কুমিরও সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

গবেষকেরা মনে করছেন, সঙ্গী ছাড়াই মেয়ে প্রাণী ডিম পাড়ার পর সেগুলো প্রজননযোগ্য কি না, তা পরীক্ষা করা উচিত। তবে ওয়ারেন বুথ মনে করেন, পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় যেসব ভ্রূণ উৎপন্ন হয়ে থাকে, সেগুলোর বেশির ভাগই খুব অসুস্থ কিংবা দুর্বল হয়ে থাকে।

বুথ বলেন, মানুষ কিংবা অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা হয় না। কারণ, তাদের ক্ষেত্রে ভ্রূণ গঠনের জন্য মেয়ে ও ছেলে—উভয়ের কাছ থেকেই সুনির্দিষ্ট কিছু জিন দরকার হয়।

গবেষক ওয়ারেন বুথ মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। গবেষকেরা পরীক্ষাগারে পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় সফলভাবে ইঁদুর উৎপাদন করেছেন। তবে এ জন্য তাঁদের অনেকটাই জিন সম্পাদনা করতে হয়েছে। তাঁদের যথাযথ সময়ের মধ্যে জিন স্থানান্তর করতে হয়েছে।

মার্কিন এই গবেষকের ধারণা, কুমির ও পাখি ডাইনোসরের কাছ থেকে এ ধরনের সক্ষমতা অর্জন করে থাকতে পারে। যদিও ডাইনোসরের ডিএনএ ছাড়া এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণের সুযোগ  নেই।

বিবিসি, নিউ সায়েন্টিস্ট ও সিএনএন থেকে ভাষান্তর করেছেন সুজন সুপান্থ