যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবারও প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের। বহু নাটকীয়তার জন্ম দেওয়া ট্রাম্প প্রার্থী হলে পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেড়ে যাবে। ২০২৪ সালের এই নির্বাচন সামনে রেখে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট শিবির থেকে ট্রাম্প ও বাইডেনের নাম শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে ট্রাম্পের বাসভবন থেকে গোপন নথি উদ্ধারের ঘটনা এই আলোচনাকে আরও জোরদার করেছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অতি গোপনীয় নথি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম। ফ্লোরিডায় তাঁর পাম বিচের মার-আ-লাগো রিসোর্টে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই)। সেখান থেকে ১১ সেট অতি গোপন নথি পাওয়ার দাবি করেছে সংস্থাটি। রিপাবলিকান পার্টির নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প এই তল্লাশিকে ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পূরণের পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। জো বাইডেনের কাছে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার দুই বছর পরে এ ধরনের কেলেঙ্কারিতে ট্রাম্পের নাম আসার বিষয়টিকে তাই আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প যদি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার কথা ভেবে থাকেন, তাহলে এফবিআইয়ের এই তল্লাশি অভিযান তাঁকে আরও মরিয়া করে তুলবে বলে মনে করা হচ্ছে। রিপাবলিকান দলের সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম অন্তত তাই মনে করেন। তিনি ফক্স নিউজকে বলেছেন, ‘আমার ধারণা ছিল, তিনি আবার লড়বেন। কিন্তু এখন সে ধারণা পোক্ত হয়েছে।’
ট্রাম্প যদি নির্বাচনে লড়েন তবে বাইডেনও লড়বেন বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বর্তমানে ৭৯ বছর বয়সী সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে বাইডেন ঐতিহাসিক মিশনে নামবেন। তাঁর এই মিশন হবে যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্পমুক্ত করা। এতে ২০২০ সালের নির্বাচন–পরবর্তী সহিংসতার সেই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি আবারো ঘটতে পারে।
তবে এবারের লড়াই হবে ক্ষমতায় থাকা ৮১ বছর বয়সী (নির্বাচন সময়কালে) বাইডেনের সঙ্গে ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্পের। ২০২০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার দাবি থেকে এখনো সরে আসেননি ট্রাম্প। নির্বাচন–পরবর্তী ক্যাপিটল হিলের হামলা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা চালাচ্ছে বাইডেন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। সব মিলিয়ে ট্রাম্প-বাইডেনের লড়াই বেশ কুৎসিত রূপ নিতে পারে বলেই বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
এ বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষক আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক অ্যালান লিচম্যান বলেছেন, ‘যদি মনে করেন ট্রাম্পের ২০১৬ ও ২০২০ সালের প্রচারাভিযান জঘন্য ছিল। তবে আপনি কিছুই দেখেননি।’
রাজনৈতিক কৌশলবিদদের চোখে ট্রাম্পের বাসভবনে এফবিআইয়ের তল্লাশির ঘটনাটি পুরো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত হিসেবে দেখা দিতে পারে। এ থেকে লাভবান হতে পারে দুই পক্ষই। বাইডেনের পক্ষে যুক্তি অবশ্য স্পষ্ট। রিপাবলিকান দলের নেতা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এখন কেবল এফবিআইয়ের তল্লাশিই নয়, নানা অভিযোগের মামলা সক্রিয় হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতারণা ও ধর্ষণের মতো মামলা। এগুলো রিপাবলিকানদের জন্য বিব্রতকর আর বাইডেনের ডেমোক্রেট পার্টির জন্য চাঙা হওয়ার মতো বিষয়। আগামী নভেম্বরেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। মার্কিন কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। এ নির্বাচনের আগের পূর্বাভাসে ডেমোক্রেট পার্টি ও বাইডেনের ভরাডুবি হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তারা এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার ছক কষছেন।
ডেমোক্রেট পার্টির থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত থার্ড ওয়ে-এর বিশ্লেষক জিম কেসলার মার্কিন গণমাধ্যম দ্য হিলকে বলেছেন, স্টেরয়েড সেবনে যেমন ব্যথা কমে শরীর চাঙা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প তেমনি ডেমোক্র্যাটদের চাঙা করেন।
এদিকে রিপাবলিকানদের সমর্থনকারী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এডিটরিয়াল বোর্ড বলছে, বাইডেনের প্রথম দুই বছরের যে কর্মকাণ্ড, তাতে রিপাবলিকানদের উচিত হবে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে গণভোটে রূপে নিয়ে যাওয়া। ডেমোক্র্যাটরা নভেম্বর পর্যন্ত কথা বলতে পছন্দ করবেন। সত্যিকার অর্থে ট্রাম্প বিষয়ে তাঁদের কথা বলার শেষ সময় পর্যন্ত তাঁরা তা চালিয়ে যাবেন।
অবশ্য এ থেকে ট্রাম্পও সুবিধা দেখছেন। আবার তিনি আলোচনায়। চলে আসছেন মার্কিন নাগরিকদের ভাবনার কেন্দ্রে। তাঁর সমর্থক গোষ্ঠী জনগণের সামনে নতুন একটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ হাজির করছেন।
রক্ষণশীল ম্যাগাজিন ন্যাশনাল রিভিউ-এর সম্পাদক রিচার্ড লোরি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক লড়াই চালাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ রয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও তাঁর কাছে মূল্যবান হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে এফবিআই-এর তদন্ত। এটা আবার তাঁকে সবার মধ্যমণি করেছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ভিকটিম হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন।’
রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাইমারিতে ট্রাম্পের আবির্ভাব অন্যান্য শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরাশয়ী করতে পারে। রিপাবলিকান দলের রাজনৈতিক কৌশলবিদ জন থমাস মার্কিন গণমাধ্যম পলিটিকোকে বলেন, ‘ট্রাম্প এখন যদি (প্রার্থী হতে) চান, তবে এটা তাঁর না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।’
ট্রাম্প নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হলে বাইডেনও একই পথ অনুসরণ করতে পারেন। আগামী নির্বাচনে না দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে বাইডেন যদি ঘুণাক্ষরেও কিছু ভেবে থাকেন, তবে তা দূরে সরিয়ে রাখবেন। জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্টের পরিচালক লারা ব্রাউন বলেন, ‘বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে আবার লড়াই হবে কি না, তা নির্ধারণে প্রথম চাল দেবেন ট্রাম্প। আমি মনে করি, ট্রাম্প নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দেন কি না, তার অপেক্ষায় আছেন বাইডেন। যদি ট্রাম্প নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেন তবে দ্রুতই তাঁকে অনুসরণ করবেন বাইডেন।’
প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা কাকে চান? সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক বাইডেন বা ট্রাম্প দুজনের কাউকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে চান না। গত জুলাই মাসে নিউজনেশন ও ডিসিশন ডেস্ক এইচকিউ একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক চান না বাইডেন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। আর ট্রাম্পকে প্রার্থী দেখতে চান না ৫৭ শতাংশ ভোটার।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার বিষয়ে নিজের সমর্থনে গত মার্চ মাসে বাইডেন বলেছিলেন, ‘আমি খুব সৌভাগ্যবান হব, যদি পরবর্তী নির্বাচনে আমার বিরুদ্ধে একই ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।’
এ বছর বাইডেনের জন্য বেশ কঠিন সময় গেছে। গত কয়েক মাসে আইন ও নীতি সংশোধনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে তাঁর প্রশাসন। তবে এখনো জনপ্রিয়তার বিচারে তলানিতেই রয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৪০ শতাংশ জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন বাইডেন।
এর আগে গত মাসে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে চান না দলটির বেশির ভাগ সমর্থক। নিউইয়র্ক টাইমস-সিয়েনা কলেজের এক জরিপে এ তথ্য উঠে আসে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনকে যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমেছে। জরিপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জনপ্রিয়তা ৩৩ শতাংশে নেমে যাওয়ার কথা বলা হয়। তবে গর্ভপাতের অধিকার প্রত্যাহার নিয়ে ক্রোধের মুখেও সম্প্রতি বাইডেনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বিষয়টি উপদেষ্টাদের আবার আশাবাদী করে তুলেছে।