আটলান্টিকের তলদেশে সাবমেরিন টাইটান কী কারণে ধ্বংস হলো, তা জানতে খতিয়ে দেখা হবে এর ধ্বংসাবশেষগুলো। মেলানোর চেষ্টা করা হবে অনেক হিসাব।
বৃহস্পতিবার টাইটানের দুটি অংশের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের কাছে পড়ে ছিল সেগুলো। এগুলো যাচাই–বাছাই করে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড টাইটান ধ্বংসের কারণ নিয়ে একটি ধারণা করছে। বাহিনীটি বলছে, সাগরের তলদেশে সাবমেরিনটিতে বিস্ফোরণ হতে পারে।
টাইটানের ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয়েছে, সাগরের তলদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরুর পর কোনো এক সময় সাবমেরিনটিতে ছিদ্র বা ফাটল দেখা দিয়েছিল। সাবমেরিনটি তখন পানির এতটাই গভীরে ছিল যে এর ওপরের পানির ওজন ছিল কয়েক হাজার টন। বলা চলে পুরো আইফেল টাওয়ারের ওজনের সমান। টাইটানের বাইরের আবরণের ভেতরে সুরক্ষিত ছিলেন অভিযাত্রীরা। তবে এতে কোনো ফাটল দেখা দিলে তা বাইরের পানির চাপে দুমড়েমুচড়ে যাওয়ার কথা।
কীভাবে টাইটানে বিস্ফোরণ হলো, আর তা ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেত, তা বের করতে তদন্তকারীরা সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষগুলো একসঙ্গে করবেন বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিন চালক রেয়ান রামসে।
রেয়ান রামসে বলেন, সাবমেরিনটিতে উড়োজাহাজের মতো কোনো ব্ল্যাক বক্স ছিল না। তাই শেষ মুহূর্তে সেটিতে কী হয়েছিল, তা জানা যাবে না। এ ছাড়া তদন্তের অন্য প্রক্রিয়াগুলো একটি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্তের চেয়ে আলাদা হবে না।
তবে টাইটানের কোথায় ফাটল ধরেছিল, তা বের করা কঠিন হবে। কারণ, পুরো সাবমেরিনটি ছোট ছোট অংশে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আর এই অংশগুলো উদ্ধার করা আরও কঠিন হবে। কারণ, সেগুলো পানির অনেক গভীর থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে।
টাইটানের মালিক প্রতিষ্ঠান ওশানগেটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাবমেরিনটির বহিরাবরণের অবস্থা সব সময় পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। ফলে সাবমেরিনটি পানির গভীরে যাওয়ার সময় বহিরাবরণের ওপর কী প্রভাব পড়ছে তা দেখা যেত। কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা–ও জানিয়ে দিত ওই পর্যবেক্ষণব্যবস্থা।
এটি টাইটানে পূর্বসতর্কতা ব্যবস্থার মতো কাজ করত। এটি যদি কাজ করত, তাহলে সাবমেরিনটির চালক দুর্ঘটনার আভাস আগে থেকেই পেতেন এবং সেটিকে সাগরপৃষ্ঠে উঠিয়ে নিতেন। সাবমেরিনটির বহিরাবরণে কোনো সমস্যা হলে, কেন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা কাজ করেনি তা বের করার চেষ্টা করবেন তদন্তকারীরা।
টাইটানের ধ্বংসাবশেষগুলো সংগ্রহ করার পর সেগুলো পরীক্ষা করে দেখবেন তদন্তকারীরা। প্রতিটি ধ্বংসাবশেষ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে যাচাই করা হবে। খুঁজে দেখা হবে ঠিক কোথায় ফাটল দেখা দিয়েছিল।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পর্যাপ্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া টাইটান পানিতে নামানো হয়েছিল। এখন সেটির ধ্বংসাবশেষগুলো যাচাই করে যদি কোনো ফাটল পাওয়া যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাই কি সত্যি ছিল?
বেশির ভাগ বাণিজ্যিক জলযানগুলোর চলাচলের জন্য অনুমোদন নিতে হয়। এ অনুমোদনের জন্য পুরো যানটি খতিয়ে দেখা হয় যে সুর্নিদিষ্ট মান অনুযায়ী সব নির্মাণ করা হয়েছে কি না। তবে ওশানগেটের বিষয়টা ভিন্ন। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, টাইটান পরীক্ষামূলক যান। আর সাবমেরিনটি এতটাই উদ্ভাবনী ছিল যে অনুমোদনের জন্য প্রচলিত মানগুলো এটির উপযুক্ত নয়।
তবে সম্প্রতি তাদের এই বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ডেভিড অ্যান্ড্রুস বলেন, গবেষণার জন্য অনুমোদন ছাড়া কোনো যান পানিতে নামালে সেটি ঠিক আছে। তবে যখন যাত্রী নিয়ে আয় করা শুরু করবেন, তখন অনেকেই কথা তুলবে।
তদন্তে খতিয়ে দেখার মতো আরেকটি বিষয় রয়েছে। সেটি হলো, প্রতিবার টাইটান সাগরের গভীরে যাওয়ার পর পানির চাপে সংকুচিত হতো। ওপরে উঠে এলে সেটি স্বাভাবিক আকৃতিতে ফিরে আসত। বারবার এমনটি হওয়ায় সাবমেরিনটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বিষয়টি নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হতো কি না, তা স্পষ্ট নয়।
টাইটান ধ্বংসের ঘটনা কারা তদন্ত করবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ডের রিয়ার অ্যাডমিরাল জন মাউগারের মতে, কারা তদন্ত করবে তা নির্ধারণ করাটা জটিল। কারণ, ঘটনাটি আন্তর্জাতিক জলসীমায় ঘটেছে। আর সেটির তল্লাশিতে অনেক দেশ জড়িত ছিল।
তবে টাইটান নিখোঁজের পর থেকে তল্লাশির কাজে মূল ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড। তাই ধরে নেওয়া যায়, তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এই বাহিনী।