নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ

প্রিগোশিনবিহীন ভাগনারের হাল ধরবে কে

স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে, ২৪ আগস্ট তোলা
ফাইল ছবি রয়টার্স

একসময় রাশিয়ার প্রভাবশালী বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ছিল ভাগনার। তবে গত জুনে রুশ সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করার পর প্রতিষ্ঠানটির ওপর থেকে ক্রেমলিনের ছায়া সরে যেতে থাকে। আর গত বুধবার (২৩ আগস্ট) থেকে বাহিনীটি আরও বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এদিন ভাগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনকে বহনকারী উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে। রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ গতকাল রোববার তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে তারা।

ইয়েভগেনি প্রিগোশিন

এখন একটি প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। ভাগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর পরও তাঁর এক দশকের পুরোনো প্রতিষ্ঠানটি কি টিকে থাকবে, নাকি শেষ হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেছেন, ভাগনারকে আরও বেশি করে রাশিয়ার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় খুঁজছে ক্রেমলিন। তবে এ বাহিনীর ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি তারা।

২০১৪ সালে ভাগনার প্রতিষ্ঠা করেন প্রিগোশিন। কমপক্ষে ১০টি দেশে এটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। মনে করা হচ্ছে, ভাগনারের প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের হারাতে চাইবে না রাশিয়া। পুতিনের ২৩ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় হুমকি সৃষ্টিকারী এ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়াটা সহজ কাজ নয়।

একটি বড় বিষয় হলো, জুনের বিদ্রোহের ঘটনার পর একক কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির হাতে ভিন্ন ভিন্ন অভিযান পরিচালনার একচ্ছত্র ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেওয়া হবে না। একজনের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নেতাকে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করানো হতে পারে।
ক্যাটরিনা ডক্সসি, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী ফেলো

পুতিন ও রুশ নেতারা কী ভাবছেন

ভাগনারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে পুতিন এখন পর্যন্ত মিশ্র ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এ বছরের জুনের শেষের দিকে ভাগনার বাহিনীর বিদ্রোহ শেষ হওয়ার পর পুতিনের সঙ্গে বাহিনীটির কমান্ডারদের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পুতিন বলেছিলেন, ভিন্ন নেতার অধীন তাঁরা কাজ করে যেতে পারেন। গত মাসে রাশিয়ার সংবাদপত্র কোমারস্যান্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। রুশ প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁর প্রস্তাবে ভাগনার কমান্ডারদের অনেকে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ালেও প্রিগোশিন তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

একই সাক্ষাৎকারে পুতিন আরও বলেন, রাশিয়ার আইন অনুযায়ী বেসরকারি সামরিক কোম্পানির কাজ করার অনুমতি নেই। সেদিক থেকে ভাগনারের অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও একই ধরনের কথা বলেছেন। আর এসব বক্তব্য ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাশিয়ায় ভাগনারের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

২৩ আগস্ট রাশিয়ার তিভের অঞ্চলে কুঝেঙ্কিনো গ্রামের কাছে প্রিগোশিনকে বহনকারী উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়

রাশিয়ার পার্লামেন্টের সদস্য আলেকসান্দর বোরোদাই নিউইয়র্ক টাইমসকে ফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পিএমসি ভাগনার নামের প্রতিষ্ঠানটির নিজেরই অস্তিত্ব না থাকার আশঙ্কা বেশি। তবে তিনি মনে করেন, ভাগনারের যোদ্ধারা সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হয়ে লড়াই চালিয়ে যাবেন।

বোরোদাই আরও বলেন, ভাগনার যোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে যাবেন। তাঁরা ইতিমধ্যে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক ইউনিটগুলোর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছেন। তাঁদের সংখ্যাটা অনেক। তাঁদের আসার এ ঢেউটা গতকাল শুরু হয়েছে আবার আগামীকালই শেষ হয়ে যাবে, এমনটা নয়। লোকজন আসছেন। তাঁরা লড়াই চালিয়ে যাবেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা আছে।

২০১৪ সালে কিছুদিনের জন্য ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলে রাশিয়া মনোনীত নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বোরোদাই।

ভাগনারের যোদ্ধারা যা ভাবছেন

উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রিগোশিন ছাড়াও ভাগনারের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার দিমিত্রি উতকিনেরও মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে রাশিয়া। এ ছাড়া ভাগনারের সঙ্গে সম্পৃক্ত পাঁচ যাত্রী ও তিনজন ক্রু নিহত হয়েছেন।

প্রিগোশিন মারা গেলেও তিনি তাঁর ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য কিছু লোক রেখে গেছেন।

ভাগনারের ‘কাউন্সিল অব কমান্ডারস’ নামের একটি দল আছে। ভাগনারের টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেওয়া বর্ণনায় বলা আছে, এই কাউন্সিল বাহিনীর কার্যক্রমগুলো তদারক করে থাকে। কাউন্সিলটির সব সদস্য প্রিগোশিনের সঙ্গে ওই উড়োজাহাজে ছিলেন না। তাঁরা বেঁচে আছেন।

উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভাগনার কমান্ডারদের কেউ এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বক্তব্য দেননি। কোনো বিবৃতিও প্রকাশ করেননি তাঁরা। তবে ভাগনারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোয় বারবারই বলা হচ্ছে, শিগগিরই একটি ঘোষণা আসবে।

মস্কোয় রাস্তার পাশে ভাগনার বাহিনীর নিহত নেতাদের জন্য অস্থায়ীভাবে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। যোদ্ধাদের কেউ কেউ সেখানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস, বেসরকারি এই বাহিনী তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

তাঁদেরই একজন আদঝিত (ডাক নাম)। ৩৬ বছর বয়সী এই তরুণ ভাগনারের স্বেচ্ছাসেবী। তিনি বলেন, ‘ভাগনারের ভেতরকার কাঠামো সম্পর্কে আপনাদের যদি ধারণা থাকে, তাহলে আপনারা একটি বিষয় বুঝতে পারবেন। আর তা হলো, একজন, দুজন কিংবা তিনজনের মৃত্যুতে এ কার্যক্রমের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।’

যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সহযোগী ফেলো ক্যাটরিনা ডক্সসি বলেন, একটি বড় বিষয় হলো, জুনের বিদ্রোহের ঘটনার পর একক কোনো কোম্পানি বা ব্যক্তির হাতে ভিন্ন ভিন্ন অভিযান পরিচালনার একচ্ছত্র ক্ষমতা বা দায়িত্ব দেওয়া হবে না। একজনের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নেতাকে দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করানো হতে পারে।

প্রিগোশিনের সঙ্গে রুশ সেনা কর্মকর্তাদের যে শত্রুতা ছিল তার প্রভাব যেন এসব কার্যক্রমের ওপর না পড়ে, তা–ও পুতিন নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পরই মূলত ভাগনার বেশি পরিচিতি লাভ করতে থাকে।

রাশিয়ার জনগণ, দেশটির কারাবন্দী লোকজনদের মধ্য থেকে বাহিনীটিতে বিপুল যোদ্ধা নিয়োগ দেওয়া হয়। ইউক্রেনের বাখমুত শহরের দখল নিতে অভিযানের সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বাহিনীটির প্রশংসা করা হয়েছিল। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের আগে প্রিগোশিন খুব একটা প্রকাশ্যে কথা বলতেন না।

তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিতে শুরু করেন।

বাহিনীটি এমন পরিচিতি পাওয়ার কারণে এটিকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করে দেওয়াটা ক্রেমলিনের জন্য কঠিন কাজ।

আবারও মস্কোর রাস্তায় ফিরে যাওয়া যাক। সেখানে ভাগনারের নিহত নেতাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে তৈরি অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে তিন ভাগনার সেনার সঙ্গে কথা বলেছে নিউইয়র্ক টাইমস। তাঁদের দাবি, ভাগনারকে ভেঙে দেওয়া যাবে না।

তাঁদের মধ্যে প্রাপর নামের একজন বলেন, ‘আমরা সবাই পাশে থেকেছি। আমরা কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। আমরা কাউকে একা ফেলে যাইনি এবং শেষ পর্যন্ত এভাবেই থাকব।’

নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে প্রাপরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি ভাগনারের সঙ্গে করা চুক্তি ছেড়ে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি।

প্রাপর শুধু বলেন, ‘আমাদের একটাই চুক্তি। সে চুক্তিটা করা হয়েছে মাতৃভূমির সঙ্গে।’