ইজমায়েল ‘এল মায়ো’ জামবাদা ও হোয়াকিন গুজম্যান লোপেজ
ইজমায়েল ‘এল মায়ো’ জামবাদা ও হোয়াকিন গুজম্যান লোপেজ

মেক্সিকোর দুই মাদকসম্রাট যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তারের প্রভাব কী হতে পারে

মেক্সিকোর কুখ্যাত মাদক পাচার চক্র সিনালোয়া কার্টেলের দুই শীর্ষ নেতা এক নাটকীয় অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হন। মেক্সিকো সরকারের সহায়তা ছাড়াই তাঁদের গ্রেপ্তারে সক্ষম হন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের একজন সিনালোয়া কার্টেলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইজমায়েল ‘এল মায়ো’ জামবাদা। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এল পাসো থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা।

এল মায়োকে বিশ্বের অন্যতম বড় মাদকসম্রাট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মাদক-সংশ্লিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি গত শুক্রবার আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।

এল মায়োর আগে মার্কিন গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়েন সিনালোয়া কার্টেলের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা হোয়াকিন ‘এল চাপো’ গুজম্যানের ছেলে হোয়াকিন গুজম্যান লোপেজ। এল চাপো আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী।

সিনালোয়া কার্টেল বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ, সহিংস ও শক্তিশালী মাদক পাচার চক্রগুলোর একটি। চক্রটির সুপরিচিত মুখ এল চাপো। তবে অনেকে মনে করেন, এল মায়োই চক্রটির মূল হোতা।

মেক্সিকোর দুই কুখ্যাত মাদকসম্রাট এল মায়ো ও গুজম্যান লোপেজ গ্রেপ্তার হওয়ার সম্ভাব্য প্রভাব কী হতে পারে, তা খতিয়ে দেখেছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

সিনালোয়া কার্টেলের ওপর প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী সংস্থা ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ডিইএ) প্রধান অ্যান মিলগ্রাম বলেন, বিশেষ করে এল মায়োর গ্রেপ্তার সিনালোয়া কার্টেলের কেন্দ্রে আঘাত করেছে। ফেনটানাইল, মেথামফেটামাইনসহ ভয়ংকর যেসব মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা হয়, তার সিংহভাগই সরবরাহ করে এই চক্রটি। বহু মার্কিনের মৃত্যুর কারণ এই মাদক।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল মায়ো ও গুজম্যান লোপেজের গ্রেপ্তারের ঘটনা শক্তিশালী এই অপরাধী সংগঠনটিকে অচল করে দেবে না।

ইনসাইট ক্রাইম নামের একটি গবেষণা সংস্থার বিশ্লেষকদের মতে, দুই মাদকসম্রাটের গ্রেপ্তারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবে বিষয়টি মার্কিন কর্তৃপক্ষের জন্য অনেকটা প্রতীকী বিজয়ের মতো।

এল মায়ো দশকের পর দশক ধরে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তাঁর মাদকসাম্রাজ্যের কার্যক্রম চালিয়ে এসেছেন। ইনসাইট ক্রাইমের বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই এল মায়ো কার্টেলের প্রতিদিনকার কার্যক্রম থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

আরেক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক ফালকো আর্নেস্টের ভাষ্যমতে, কার্টেলটির কাঠামো এমন, যেখানে হাজারো নেতা আছেন। এর ফলে এক বা দুজন নেতার পতনে কার্টেলের মৌলিক প্রকৃতিতে কখনোই বদল আসবে না।

মাদক পাচারের ওপর প্রভাব

ওয়াশিংটনভিত্তিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ ভান্ডা ফেলবাব-ব্রাউন বলেন, এই গ্রেপ্তারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটানাইলসহ অন্যান্য মাদকের প্রবাহ বড় পরিসরে কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, সিনালোয়া কার্টেলের কার্যক্রম নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়। তা ছাড়া এল চাপোর দুই ছেলে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন। তাঁদের মধ্যে জিসাস চক্রটির আন্তর্জাতিক কার্যক্রমের মূল দায়িত্বে আছেন।

ফেলবাব-ব্রাউনের ধারণা, সিনালোয়া কার্টেলের পতন হলেও তার জায়গা দখল করে নেবে প্রতিদ্বন্দ্বী জালিসকো নিউ জেনারেশন কার্টেল। তখন তারা যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটানাইলসহ অন্যান্য মাদক সরবরাহ করবে।

দুই মাদকসম্রাটকে গ্রেপ্তারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সিনথেটিক মাদক, বিশেষ করে ফেনটানাইলের প্রবাহে খুব একটা প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন ইনসাইট ক্রাইমের বিশ্লেষকেরা।

কার্টেল সহিংসতা কি বাড়বে

প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অতিসহিংস সংঘাতে যুক্ত আছে সিনালোয়া কার্টেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিনালোয়া কার্টেলের দুই নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর অন্যরা নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে তৎপর হতে পারে। এতে বাড়তে পারে সহিংসতা।

তা ছাড়া সংগঠনের ভেতরকার উপদলগুলোর মধ্যে কোন্দল-বিরোধ আছে। এখন বাড়তে পারে অন্তর্দ্বন্দ্ব।

ফেলবাব-ব্রাউন বলেন, মেক্সিকোতে এমনিতেই অপরাধীদের মধ্যে তীব্র সহিংসতার প্রবণতা আছে। এল মায়ো ও গুজম্যান লোপেজের গ্রেপ্তারের ঘটনায় সহিংসতা আরও বাড়তে পারে, যা মেক্সিকোর অপরাধজগৎ ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে জালিসকো নিউ জেনারেশন কার্টেল।

ক্রাইসিস গ্রুপের ফালকো আর্নেস্ট বলেন, মেক্সিকোয় প্রায় ২০০ সশস্ত্র অপরাধী গোষ্ঠী আছে। এতগুলো গোষ্ঠীর সক্রিয় উপস্থিতির কারণে মাদক পাচার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষের জন্য অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।

কূটনীতিক প্রভাব

মেক্সিকোর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বৃহস্পতিবারের মার্কিন অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এমনকি অভিযানের বিষয়ে আগে তাদের জানানোও হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী কর্তৃপক্ষ ডিইএর এমন সব কার্যক্রম সম্পর্কে মেক্সিকোকে অন্ধকারে রাখার অভিযোগ আগে করেছিল দেশটির সরকার। মাদক পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালে মেক্সিকোর সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী সালভাদর সিয়েনফুয়েগোসকে গ্রেপ্তার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে এ ঘটনার পর মেক্সিকোকে অন্ধকারে রাখার বিষয়টি সামনে আসে।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদোর অভিযোগ করেন, সালভাদরের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের বানোয়াট অভিযোগ এনেছে ডিইএ। প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি মেক্সিকোর মাটিতে বিদেশি গোয়েন্দাদের কার্যক্রম সীমিত করে দেন।

ডিইএর আন্তর্জাতিক কার্যক্রমবিষয়ক সাবেক প্রধান মাইক ভিজিল বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষত তৈরি হয়েছে। সিনালোয়া কার্টেলের দুই নেতাকে গ্রেপ্তারের জেরে সম্পর্ক নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কিছু নেই।

মাইক ভিজিলের ধারণা, এল মায়ো ও গুজম্যান লোপেজকে গ্রেপ্তার করার আগে এ বিষয়ে মেক্সিকোকে কিছু না জানানোর কারণ হলো, তারা চায়নি অভিযান কোনোভাবে ভেস্তে যাক।