যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা অ্যানেল শেলাইন
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা অ্যানেল শেলাইন

ইসরায়েলকে সমর্থনের প্রতিবাদ

পদত্যাগ করে যা লিখলেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা

ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সমর্থনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

গতকাল বুধবার অ্যানেল শেলাইন নামের এই কর্মকর্তা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। একটি খোলাচিঠিতে পদত্যাগের কারণও তুলে ধরেছেন ৩৮ বছর বয়সী ওই নারী কর্মকর্তা।

শেলাইন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পান। তিনি ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড লেবারের পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। চাকরির মেয়াদের মাঝামাঝিতে এসে পদত্যাগ করলেন তিনি।

কী আছে খোলাচিঠিতে

শেলাইনের খোলাচিঠিটি সিএনএনের মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে। ওই চিঠির কিছু অংশের ভাষান্তর নিচে তুলে দেওয়া হলো:

গত ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর থেকে গাজায় যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমা ব্যবহার করে আসছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ যুদ্ধে ৩২ হাজারে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তাঁদের ১৩ হাজারই শিশু। এ ছাড়া বহু মানুষের মরদেহ ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর ও স্থাপনার নিচে পড়ে আছে।

খাদ্য অধিকার–সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের মতে, গাজার বেঁচে থাকা ২০ লাখ মানুষকে অনাহারে রাখার জন্য ইসরায়েল নিশ্চিতভাবেই অভিযুক্ত। দাতব্য সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের একটি দল সতর্ক করে বলেছে, পর্যাপ্ত ত্রাণসহায়তা না পেলে আরও হাজারো মানুষের নাম শিগগিরই মৃত মানুষের তালিকায় যোগ হবে।

এরপরও ইসরায়েল এখনো রাফায় অভিযানের পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, যেখানে গাজার অধিকাংশ মানুষ পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, সেখানে যে হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটা হবে ‘কল্পনাতীত’।

পশ্চিম তীরে সশস্ত্র বসতি স্থাপনকারী ও ইসরায়েলি সেনারা মার্কিন নাগরিকসহ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে আসছেন। গণহত্যাবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী, এসব কর্মকাণ্ড গণহত্যার অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। আর মার্কিন সরকারে কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন নিয়েই এসব কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মানবাধিকারের প্রসারে গত বছর এই দপ্তরে আমি কাজ করেছি। দপ্তরের এই অভিপ্রায় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। কিন্তু এমন একটি সরকার, যারা সরাসরি এমন বিষয়কে সহায়তা করছে, যা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বলেছেন, গাজায় গণহত্যা ঘটে থাকতে পারে; তাদের প্রতিনিধি হয়ে এ ধরনের (মানবাধিকার নিয়ে) কাজ করে যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ধরনের নৃশংসতাকে সহায়তা করে—এমন প্রশাসনের অধীন কাজ করতে অসমর্থ হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার পদ থেকে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ফিলিস্তিনের জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি হামলায় নিহত শিশুর লাশ কোলে শোকাতুর এক বাবা

শুরুতে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগের পরিকল্পনা আমার ছিল না। কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার চাকরির মেয়াদ স্বল্পমেয়াদি। আমাকে দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে আমার পদত্যাগে তেমন কিছু যায়–আসে বলে আমার মনে হয়নি। কিন্তু যখন আমি আমার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি, বারবার যে প্রতিক্রিয়া আমি শুনেছি, তা হলো, ‘অনুগ্রহ করে আমাদের হয়ে বলুন’।

কেন্দ্রীয় সরকারে আমার মতো যাঁরা কর্মী আছেন, কয়েক মাস ধরে তাঁরা নীতি পরিবর্তনে চাপ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। উভয়ভাবেই—অভ্যন্তরীণভাবে আর যখন তা ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রকাশ্যেই।

আমার সহকর্মীরা এবং আমি হতবিহ্বল হয়ে দেখলাম, এই প্রশাসন ইসরায়েলকে নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হাজারো যুদ্ধাস্ত্র, বোমা, ছোট অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে। আরও হাজারো অনুমোদন করেছে, এমনকি কংগ্রেসকে পাস কাটিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের আইনের প্রতি প্রশাসনের স্পষ্ট অবহেলায় আমরা হতবাক হয়েছি। এসব আইন মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত বা মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয়—এমন বিদেশি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদানে যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধ করে।

আমি যা করছিলাম, তা আর চালিয়ে যেতে পারছি না। আমি আশা করি, আমার পদত্যাগ ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে প্রশাসনকে চাপ দেওয়ার যে অনেক প্রচেষ্টা, তাতে অবদান রাখতে পারে। আর এটা হলো জীবনের ঝুঁকিতে থাকা ২০ লাখ ফিলিস্তিনি এবং বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানের স্বার্থেই।