মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, বৃষ্টি ঝরছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে গতকাল সোমবার থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের টাকোমা বন্দরে বিক্ষোভ চলছে। একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ আটকে দিতে তাঁদের এই বিক্ষোভ। তাঁদের ধারনা, যুদ্ধাস্ত্র বোঝাই করে এই যুদ্ধজাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েল যাচ্ছে।
বিক্ষোভকারীদের আশঙ্কা, এই যুদ্ধজাহাজে বোঝাই করে নেওয়া অস্ত্র ইসরায়েল চলমান সংঘাতে গাজার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। ৩১ দিন ধরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় প্রায় ৬ হাজার নারী–শিশুসহ ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
টাকোমায় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ওয়াসিম হেজ বলেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধবিরতি চাই। আমরা এখন মানুষ হত্যা বন্ধ করাতে চাই। আমরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আসল পরীক্ষা দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই, ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল দেওয়া বন্ধ হয়েছে।’
আরব রিসোর্সেস অরগানাইজিং সেন্টারে (এআরওসি) ওয়াসিম হেজ কেস ম্যানেজার ও কমিউনিটি আউটরিচ সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। সংগঠনটি গতকাল টাকোমা বন্দরে প্রতিবাদ বিক্ষোভের আয়োজন করেছে।
হেজ বলেন, একটি গোপন সূত্রে এআরওসি জানতে পেরেছে, এই জাহাজে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করা হবে। এখান থেকে জাহাজটি ইসরায়েল যাবে। এই ইসরায়েলই গাজায় অনবরত বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে।
আল–জাজিরা বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করতে পারেনি। তবে পেন্টাগনের মুখপাত্র জেফ জারগেনসন কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলকে এক ই–মেইল বার্তায় বলেন, আসলে জাহাজটি ‘মার্কিন সামরিক পণ্য পরিবহনে’ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
জারগেনসন আর কোনো তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানান। ই–মেইলে তিনি লেখেন, প্রতিরক্ষা দপ্তরের নানা কর্মকাণ্ডের গোপনীয়তার খাতিরে সামরিক পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত জাহাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া যাবে না।
গতকাল প্রতিবাদকারীরা বৃষ্টির মধ্যে বন্দরমুখী সড়কে লাইন ধরে অবস্থান নেন। এ সময় তাঁদের কাছে তিনটি বড় ব্যানার দেখা যায়, যাতে ‘ইসরায়েলকে কোনো সহায়তা নয়’সহ নানা স্লোগান ছিল।
টাকোমা বন্দরে অপেক্ষমাণ কেপ ওরলান্ডো জাহাজকে কেন্দ্র করে রেইনকোট ও জ্যাকেট পরে এবং ছাতা নিয়ে কর্মসূচিতে অংশ নেন প্রতিবাদকারীরা। এ সময় তাঁরা বন্দরের ডকের বাইরে অবস্থান নেন।
বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনি পতাকা নাড়িয়ে ‘গাজাকে রক্ষা করো’, ‘ফিলিস্তিনকে মুক্ত করো’, ‘ইসরায়েলের অপরাধের জন্য আর কোনো কানাকড়ি সহায়তা নয়’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
বিক্ষোভকারীরা বন্দরের সড়ক বন্ধ করে দিতে বাইসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে আসেন। প্রতীকী হিসেবে জাহাজের চারপাশে ওয়াটার ওয়ারিয়র্স কাউন্সিলের সদস্যরা পানিতে সাতটি ডিঙ্গিনৌকা নিয়ে অবস্থান নেন।
ওয়াটার ওয়ারিয়র্স কাউন্সিল অব দ্য পুআলাপ ট্রাইবের নারী প্রতিবাদকারী প্যাট্রিসিয়া গঞ্জালেস বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের ইতিহাসের সঙ্গে তাঁদের অনেকটা মিল রয়েছে বলে তিনি এই বিক্ষোভে নৌকা নিয়ে সাগরে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
গঞ্জালেস বলেন, তাঁর আদিবাসী পূর্বপুরুষদের বোর্ডিং স্কুলে জোর করে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিভাবে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কানাডার সরকার, এমনকি পোপ ফ্রান্সিস এসব স্কুলকে ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’-এর অস্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন।
গঞ্জালেস আরও বলেন, তাঁর সম্প্রদায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এখনো সেই ভীতিকর ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘যখন বিষয়টি গণহত্যা হয়, তখন আমাদের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকে না।’
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অ্যাবি ব্রুক একজন ইহুদি। তিনি জায়নবাদবিরোধী। তিনি গতকাল টাকোমা বন্দরে বিক্ষোভ আয়োজনে সহায়তা করেন। তিনি ইসরায়েলের পাশাপাশি পশ্চিম তীর ও গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের দখল করা অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। এসবই তাঁকে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহিত করেছে।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে এই ইহুদি নারী বলছিলেন, ‘আমার বয়স যখন ১৮, আমি তখন ফিলিস্তিনে গিয়েছিলাম। আমি তখন ইসরায়েলি দখলদারি এবং উপনিবেশিক বসতি স্থাপনের বিষয়টি দেখেছি। আমি চেকপয়েন্ট দেখেছি। নকবায় ঘরবাড়িহারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছি।’
অ্যাবি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা প্রতিদিন কীভাবে জীবন যাপন করছেন, আপনি যখন সেটা দেখবেন, তখন কী ঘটছে, সেটা জানতে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করতে হবে না। বাস্তবতা হচ্ছে, সামরিক দখলদারির মাধ্যমে ইসরায়েল হচ্ছে এক জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্র।’
টানা দ্বিতীয় সপ্তাহে কেপ ওরল্যান্ডো জাহাজ সমুদ্রে যাত্রা করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ল। গত শুক্রবার ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড বন্দর থেকে কেপ ওরল্যান্ডো যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছিল। তখন তিন বিক্ষোভকারী জাহাজের সিঁড়ি বন্ধ করে দেন। এ কারণে তখনো জাহাজটির যাত্রা কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত হয়।
মার্কিন উপকূলরক্ষী বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছিল, তারা একপর্যায়ে তিন বিক্ষোভকারীকে জাহাজের সিঁড়ি থেকে সরিয়ে দেয়। ফেডারেল আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তাঁদের ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
গতকাল টাকোমা বন্দরে বিক্ষোভের আয়োজকদের অন্যতম হেজ কেপ ওরল্যান্ডো জাহাজ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তাঁরা এই সামরিক সরঞ্জামবাহী জাহাজ আটকে দিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে জোরালো বার্তা পাঠাতে চান।
কয়েক দিন আগে কেপ ওরল্যান্ডো জাহাজ টাকোমা বন্দরে ভেড়ে। সম্প্রতি ইসরায়েলকে ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের সহায়তা দিতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেন। এর মধ্যে ২০২৩ সালের মধ্যে ৩৮০ কোটি ডলারের সহায়তা দেওয়া হবে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সবচেয়ে বেশি সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাজেটের ১৬ শতাংশ সহায়তা দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।
হেজ বলেন, তাঁদের প্রতিবাদ–বিক্ষোভ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজে সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করছেন। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে তাঁরা ওই জাহাজে সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই বন্ধ করতে পারছেন না। তবে তাঁদের সাফল্য এ–ই যে তাঁরা জাহাজের যাত্রায় বিলম্ব ঘটাতে পেরেছেন।