ইলন মাস্ক
ইলন মাস্ক

টেসলা, স্পেসএক্স কিংবা টুইটার: সবখানে কি একই আচরণ ইলন মাস্কের

২০১৮ সালের কথা। বিদ্যুৎ–চালিত গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলা তখন তাদের মডেল-থ্রি গাড়ির উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। টেসলার প্রধান ইলন মাস্ক তখন কাজের চাপ সামলাতে প্রতিষ্ঠানটির কারখানার কনফারেন্স রুমে ঘুমাতে শুরু করেন। তিনি তখন বিনা নোটিশে কোম্পানির কর্মী এবং নির্বাহীদের বরখাস্ত করেছিলেন। ইলন মাস্ক কর্মীদের বারবার সতর্ক করছিলেন যে কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে।

সম্প্রতি মাস্কের মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান টুইটারে সেসব দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। টুইটারের নতুন মালিক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাস্ক কোম্পানিটির পুনর্গঠনের কাজে বেশি সময় দিচ্ছেন। সান ফ্রান্সিসকোতে কোম্পানির বিভিন্ন কার্যালয়ে ঘুমাচ্ছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরই পরই মাস্ক কোম্পানিটির কর্মী ছাঁটাই করেছেন, কর্মীদের কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে দিয়েছেন, দেউলিয়াত্বের ঝুঁকির কথা বলছেন।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মী ছাঁটাই, দেউলিয়াত্বের আশঙ্কা, কর্মীদের কঠোরভাবে কাজের নির্দেশ দেওয়া—এগুলো বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের জন্য নতুন কিছু নয়। ইলন মাস্ক গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি টেসলা ও রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সে এসব নীতিমালা অনুসরণ করে আসছেন। শুধু টেসলা বা স্পেসএক্স নয়, নিজের মালিকানাধীন অন্য কোম্পানিগুলোতেও তাঁকে বারবার এসব কৌশল খাটাতে দেখা গেছে। সম্প্রতি তাঁর মালিকানায় আসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানি টুইটারও এ থেকে বাদ যাচ্ছে না।

অক্টোবরে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার মূল্যে টুইটারের মালিকানা কিনে নেওয়ার পর পরই কোম্পানিটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন ইলন মাস্ক। এরপর কোম্পানির আর্থিক সংকটের কথা বলতে থাকেন। টুইটারের মালিকানা নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় জনবলের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৩ হাজার ৭০০ কর্মীকে ছাঁটাই করেন মাস্ক।

এখানেই শেষ নয়। মাস্ক কর্মীদের বলে দিয়েছেন হয় কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, নয়তো কোম্পানি ছাড়তে হবে। কর্মীদের কাছে ইলন মাস্কের পাঠানো এক ই–মেইলে বলা হয়েছে, ‘সামনের রাস্তা কঠিন এবং সফল হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হবে।’ তাঁর হুঁশিয়ারির পর কর্মীদের অনেকে পদত্যাগ করেছেন।

দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টুইটারের আগের মালিকানায় কর্মীরা কথা বলা কিংবা কোম্পানির সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, তা এখন আর তাঁরা পাচ্ছেন না। এখন সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের চাকরি হারাতে হচ্ছে।

অন্য কোম্পানিতে ইলন মাস্কের আচরণ যেমন

মাস্কের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে একটি প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়। তা হলো প্রায়ই মালিকপক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করা হয় কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।
কর্মীদের প্রতি বিরূপ আচরণের কারণে মাস্ককে বারবার মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে। গত জুনে টেসলার বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক দুই কর্মী। তাঁরা বলেন, নেভাদা অঙ্গরাজ্যের স্পার্কস শহরে টেসলার গিগাফ্যাক্টরিতে তাঁরা কাজ করতেন। গত জুনে তাঁদের অপসারণ করা হয়।

মামলার নথি অনুযায়ী, নেভাদায় টেসলার ওই কারখানার পাঁচ শতাধিক কর্মীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কর্মীদের অভিযোগ, গণহারে কর্মীদের অব্যাহতি দেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইন মানেনি টেসলা। ফেডারেল আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের এভাবে চাকরিচ্যুত করতে চাইলে অন্তত ৬০ দিন আগে বিষয়টি তাঁদের জানাতে হবে। টেসলা সেটা না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তাঁরা।

২০১৮ সালে টেসলার কর্মীদের নতুন এক গোপনীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী টেসলার কর্মীদের গণমাধ্যমে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্বাধীন সংস্থা ন্যাশনাল লেবার বোর্ড (এসএলআরবি) ও চুক্তিটি নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জ জানায়। তাদের অভিযোগ ছিল, চুক্তিটি কর্মীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।

সাবেক এক স্পেসএক্স কর্মী ইলন মাস্কের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতার কথা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন। ২০১৭ সালে মাস্ক বলেছিলেন, দুই সপ্তাহ অন্তর স্পেসএক্সকে রকেট উৎক্ষেপণ করতে হবে, না হলে কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে।

স্পেসএক্সের সাবেক ওই নির্বাহী মনে করেন, বিভিন্ন গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে যে কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে, সেটি দেউলিয়াত্বের হুমকিতে আছে বলাটা আসলে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার কৌশল ছিল। এরপর স্পেসএক্স সফলভাবে মহাকাশে অনেক রকেট পাঠিয়েছে। এগুলো আবার নিরাপদে পৃথিবীতে অবতরণও করেছে।

তবে এরপরও মাস্কের কণ্ঠে একই সুর শোনা গেছে। গত বছর এক টুইটার পোস্টে তিনি বলেন, যদি বিশ্বমন্দা দেখা দেয়, মূলধন সংকট হয়, তবে রকেট কোম্পানিটির দেউলিয়া হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

ইলন মাস্ক

ইলন মাস্কের কৌশলগুলো কতটা কার্যকর

টেসলার সাবেক দুই নির্বাহী বলেন, সংকটের আবহ তৈরি এবং কঠোর আচরণের আড়ালে মাস্ক কোম্পানিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার সুযোগ পান। চরম পরিস্থিতির মধ্যেও কর্মীরা কাজ করে যাওয়ার মতো প্রস্তুত হয়ে ওঠেন।

তবে সাবেক কর্মীদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন ইলন মাস্কের ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলো আদৌ টুইটারের ক্ষেত্রে খাটবে কি না, তা নিয়ে। কারণ, টেসলা ও স্পেসএক্সে তিনি যখন কর্মীদের সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন, চাপ দিয়ে কাজ করিয়েছেন—তখন ওই দুই কোম্পানিই উঠতি পর্বে ছিল। কিন্তু টুইটার অনেক বেশি পরিণত কোম্পানি। বেশ কয়েক বছর ধরেই কোম্পানিটি টানা কাজ করে আসছে।

২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টেসলায় সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডেভিড ডিয়াক। তাঁর কাজ ছিল ব্যাটারি উপকরণের একটি সাপ্লাই চেইনের তদারক করা। ডিয়াক মনে করেন, মাস্কের ব্যবস্থাপনা কৌশলগুলো উদ্যোগের সূচনা পর্ব কিংবা প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো কৌশল। তবে তা কোনো কোম্পানিকে স্থিতিশীল করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভালো কৌশল নয়।

টেসলা ও স্পেসএক্সের সাবেক তিন ব্যবস্থাপক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, কোম্পানির প্রতি মাস্কের অঙ্গীকার প্রায়ই অনুপ্রেরণামূলক হয়ে থাকে। তবে তা কখনো কখনো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে এবং আতঙ্ক ও বলির পাঁঠা সংস্কৃতির জন্ম দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের সান্টা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক টামি ম্যাডসেন বলেন, টেসলা ও স্পেসএক্সের কর্মীদের সঙ্গে মাস্ক যে আচরণ করেছিলেন, তার সঙ্গে টুইটারে তাঁর করা আচরণের স্পষ্ট মিল রয়েছে। তবে গ্যাসচালিত গাড়ি থেকে মানুষকে বৈদ্যুতিক গাড়িতে অভ্যস্ত করে তুলতে (টেসলা) কিংবা মানুষকে চাঁদে পাঠানোর স্বপ্ন নিয়ে (স্পেসএক্স) যে কোম্পানিগুলো কাজ করছে, তাদের কর্মীদের মতো টুইটারের কর্মীদের কাছ থেকে একই ফল পাওয়া যাবে কি না, তা নিশ্চিত নয়।

ম্যাডসেন বলেন, বেশি ঝুঁকিতে বেশি প্রাপ্তি—এ মন্ত্র নিয়ে চলে টেসলা ও স্পেসএক্স। টুইটার উচ্চ ঝুঁকিতে আছে ঠিকই কিন্তু প্রশ্ন হলো এর বিনিময়ে কী প্রাপ্তি হবে তা নিয়ে।

প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ বারবারা ওটিস মনে করেন, যাঁরা ভালো নেতা তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের নির্দেশ দিয়ে কর্মীদের ই–মেইল করতে হয় না। কর্মপরিবেশ ভালো ও নিরাপদ হলে কর্মীরা সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কঠোর পরিশ্রম করেন।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে লেখা এক চিঠিতে ওটিস লিখেছেন, ‘সবচেয়ে বাজে কাজ হলো কর্মীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া। এতে তাঁদের সৃজনশীলতা, মনোবল ও স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়। যাঁরা মাস্কের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং বলেছেন তাঁরা এসব নির্দেশ মানতে পারবেন না—আমি তাঁদের প্রশংসা করি। এটি সাহসী পদক্ষেপ। যাঁরা টুইটারে থেকে গেছেন তাঁদের নিজেদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। মাস্ক হয়তো তাঁদের বকাঝকা করছেন না, কিন্তু তাঁদের সারাক্ষণই এ নিয়ে চাপের মধ্যে থাকতে হবে।’

ইলন মাস্ক,

মাস্ক টেসলার প্রধান নির্বাহী পদে বহাল। স্পেসএক্সে তিনি যতটা না ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন, তার চেয়ে বেশি রকেটের ডিজাইন প্রস্তুত করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। টানেল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোরিং কোম্পানি ও মস্তিষ্কে স্থাপনযোগ্য ইন্টারফেস প্রস্তুতকারী কোম্পানি নিউরালিংকেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইলন মাস্ক। তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে তাঁর লক্ষ্য হলো মহাকাশ ভ্রমণের প্রযুক্তি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন গ্রহে মানুষের বসতি গড়ে তোলা।

সম্প্রতি টেসলার শেয়ার হোল্ডাররা এক মামলায় অভিযোগ করেছেন মাস্ক প্রতিষ্ঠানটিতে তাঁর দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছেন। সম্প্রতি ডেলাওয়ারে শেয়ার হোল্ডারদের আইনজীবীর এক প্রশ্নের জবাবে টেসলার প্রধান বলেন, টুইটারে তিনি যতটা নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়েছেন, তা ক্ষণস্থায়ী। কোম্পানিটি পুনর্গঠনের জন্যই তিনি এখন সেখানে বেশি সময় দিচ্ছেন। পরে টুইটারে সময় দেওয়া কমিয়ে দেবেন।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স