যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি দ্বিতীয়বারের মতো জয়ী হন, তবে রক্ষণশীল রাজনীতিবিদেরা দেশজুড়ে গর্ভপাতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের চেষ্টা চালাতে পারেন। এ অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসন গর্ভপাতের অধিকার সীমিত করতে কী কী পদক্ষেপ নিতে পারে, আবার গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষের মানুষেরাই বা কীভাবে তা প্রতিহত করতে পারেন—এমন প্রশ্ন উঠছে।
গর্ভপাতের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস কেন্দ্রীয়ভাবে একটি আইন প্রণয়নের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চকক্ষ সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে এবং দলটি থেকেই প্রেসিডেন্ট হতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমস্টক অ্যাক্ট নামে একটি আইন চালু হয়েছিল। এ আইনের আওতায় ‘গর্ভপাতে ব্যবহৃত’ সরঞ্জামসহ বিভিন্ন উপকরণ ডাকযোগে আদান-প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতিরা বলেছেন, গর্ভপাতের অনুমোদিত বড়ির ক্ষেত্রে আইনটি অপ্রযোজ্য।
তবে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক লিউয়িস গ্রসম্যান মনে করেন, ট্রাম্প জেতার পর রিপাবলিকানরা যদি কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ না-ও নিতে পারেন, তারপরও তিনি (ট্রাম্প) বিভিন্ন কেন্দ্রীয় পদক্ষেপ ও বিচার বিভাগে পছন্দের বিচারপতি নিয়োগের মধ্য দিয়ে গর্ভপাতের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারেন।
সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর শাসনকালে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয়ভাবে গর্ভপাতের অধিকারের সুরক্ষা দিয়ে কয়েক দশক ধরে যে আইন চালু ছিল, ট্রাম্পের পছন্দের বিচারপতি নিয়োগের মধ্য দিয়ে সেটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অবশ্য ট্রাম্প এ ক্ষেত্রে নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিজের টেবিলে স্বাক্ষরের জন্য গর্ভপাতবিরোধী কোনো বিল পেলে সেটির বিরোধিতা করবেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প।
অতিরক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান হেরিটেজ ফাউন্ডেশন প্রকাশিত কিছু নথিতে দেখা গেছে, কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। ট্রাম্পের সাবেক কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পনাটি সাজানো হয়েছে। যদিও ট্রাম্প প্রকাশ্যে এ নথি থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গর্ভপাতের বড়ির বিরুদ্ধেই প্রথম পদক্ষেপটি নিতে পারেন ট্রাম্প। কাইজার ফ্যামিলি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে যত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ওষুধ সেবনের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ২০০০ সাল থেকে দেশটিতে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে গর্ভপাতের অনুমোদন দিয়েছে। এর জন্য সাধারণত যিনি গর্ভপাত করাতে চান, তাঁকে সশরীর হাসপাতালে যেতে হয়। তবে করোনা মহামারি চলাকালে টেলিহেলথ সেবা চালু হয়। তখন সাময়িকভাবে মেইল চালাচালি করে সেবা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সরকার এ ব্যবস্থাকে স্থায়ী রূপ দেয়।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক সোনিয়া সুটারের ধারণা, ট্রাম্প জয়ী হলে তাঁর প্রশাসন সশরীর হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা আবার চালু করতে পারে। নিয়মকানুনে যেসব শিথিলতা আনা হয়েছে, সেগুলোও বাদ দেওয়া হতে পারে। তিনি আরও মনে করেন, গর্ভপাতের অনুমোদন প্রত্যাহার করার চেয়ে এ পদক্ষেপগুলো অপেক্ষাকৃত সহজ হবে। তবে অনুমোদন বাতিলের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি।
গর্ভপাতের অধিকার বিষয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্ল্যান সি-এর বিশ্লেষক অ্যাঞ্জি জ্যঁ ম্যারি বলেন, গর্ভপাতে ব্যবহার করা প্রধান দুই ওষুধের (নাম উল্লেখ করা হলো না) প্রথমটির ওপর যদি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, তখন সরবরাহকারীরা অপরটির ওপর নির্ভর করতে পারেন। এ ওষুধ আরও বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে ব্যবহার করার অনুমতি আছে এবং এ ওষুধ নিয়ে বিধিনিষেধ খুব কম।
জ্যঁ ম্যারি বলেন, কমলা জিতলে চিকিৎসাপত্র ছাড়াই বড়িগুলো সহজলভ্য করতে গর্ভপাতের পক্ষে সোচ্চার থাকা মানুষেরা চাপ দিতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে ঊনবিংশ শতাব্দীতে কমস্টক অ্যাক্ট নামে একটি আইন চালু হয়েছিল। আইনটির আওতায় ‘গর্ভপাতে ব্যবহৃত’ সরঞ্জামসহ বিভিন্ন উপকরণ ডাকযোগে আদান-প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিচারপতিরা বলেছেন, গর্ভপাতের অনুমোদিত বড়ির ক্ষেত্রে আইনটি অপ্রযোজ্য।
সুটার এএফপিকে বলেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে গর্ভপাতে ব্যবহৃত উপকরণগুলোর ওপর জাতীয়ভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে। এতে গর্ভপাতের অনুমতি থাকা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ক্লিনিক ও হাসপাতালের সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে।
রক্ষণশীল আইনজীবী জশ ক্রাডক এএফপিকে বলেন, কংগ্রেস প্রণীত আইনটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খারাপ কিছু নেই।
যেসব নারী অন্য কোনো জায়গা থেকে এসে গর্ভপাত করাতে চান, তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার সুযোগ রেখেছিলেন বাইডেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ট্রাম্প প্রশাসন তা বাতিল করে দিতে পারে। এতে ওই নারীদের বিচারের মুখোমুখি করার পথ তৈরি হবে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সেখানে ইতিমধ্যে রো ভি ওয়েড নামের গর্ভপাতের পক্ষের আইনটি ভেস্তে গেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফেডারেল বিচারক নিয়োগের ক্ষমতাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রসম্যান বলেন, অঙ্গরাজ্যভিত্তিক আইনগুলোর ভাগ্য নির্ধারণ করতে শিগগিরই আদালত বসতে পারেন। এতে যেসব অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাতের পক্ষে সুযোগ-সুবিধা আছে, সেখানেও সেবা পাওয়াটা নারীদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
অবশ্য বিশ্লেষক জ্যঁ ম্যারি মনে করেন, গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকা মানুষেরাও যে একেবারে হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন, তা নয়। তিনি বলেন, ট্রাম্প যদি জয়ী হয়েই যান, তবে তাঁর শপথ নেওয়ার আগের সপ্তাহগুলোতে গর্ভপাতের অধিকার সুরক্ষিত রাখার জন্য বেশ কিছু কৌশল নেওয়া হতে পারে। গর্ভপাতের বড়ির মজুত বাড়ানো, বিদেশি উৎসের সন্ধান এবং সমর্থন নেটওয়ার্কগুলো জোরদার করার মতো কৌশলগুলোর কথা উল্লেখ করেন জ্যঁ ম্যারি।
গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকা সংগঠনগুলো ‘ইউ হ্যাভ অপশনস’ শীর্ষক প্রচারও চালাচ্ছে। ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে যেই জিতুক, নারীদের জন্য জরুরি উপকরণগুলো যেন তাঁদের হাতের নাগালে থাকে তা নিশ্চিত করতে চাইছে তারা।