যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে কয়েক দিন ধরে হইচই চলছে। নিজেদের নতুন স্পিকার নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছেন আইনপ্রণেতারা। দফায় দফায় ভোটাভুটির আয়োজন করতে হচ্ছে। কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে যখন আরও ক্ষমতার জন্য বিদ্রোহ চলছে, তখন নিজেদের কাজটা সেরে নীরবে শহর ছেড়েছেন উচ্চকক্ষ সিনেটের সদস্যরা। উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে জাতি।
একটি জাতীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম এ রকম, ‘কংগ্রেস বসতেই প্রতিনিধি পরিষদে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছেন কট্টরপন্থীরা।’ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার নির্বাচন নিয়ে এই অচলাবস্থা নতুন কিছু নয়। ঠিক ১০০ বছর আগেও কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
২০২৩ সালে এসে কেভিন ম্যাকার্থি যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, ১৯২৩ সালে একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন আরেক রিপাবলিকান নেতা ফ্রেডেরিখ এইচ গিলেটও।
প্রতিনিধি পরিষদের বর্তমান অচলাবস্থার কারণ নিয়ে বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক পোস্ট। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে কোন পথে এই অচলাবস্থার অবসান কী হতে পারে, সেটা নিয়েও প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবধান সামান্য। এতে তাদের আসনসংখ্যা ২২২টি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির আসনসংখ্যা ২১২টি। স্পিকার হতে রিপাবলিকান ম্যাকার্থির প্রয়োজন ২১৮ ভোট।
স্পিকার হতে রিপাবলিকান পার্টির কট্টরপন্থী আইনপ্রণেতাদের ভোট প্রয়োজন ম্যাকার্থির। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার এই রিপাবলিকান প্রতিনিধিকে স্পিকার পদে সমর্থন দিচ্ছেন না পার্টিরই উগ্র ডানপন্থী আইনপ্রণেতারা। ফলে স্পিকার হতে ২১৮ ভোটের ম্যাজিক ফিগার নিশ্চিত করতে পারছেন না তিনি।
স্পিকার নির্বাচনের ভোটাভুটিতে ২০ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পরিষদের সবচেয়ে ডানপন্থী কয়েকজন আইনপ্রণেতাও রয়েছেন।
এই আইনপ্রণেতাদের অনেকেই ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করে আসছেন। আর তাঁদের প্রায় সবাই উগ্র-রক্ষণশীল ফ্রিডম ককাসেরও সদস্য।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ওই নির্বাচনে বাইডেনের কাছে পরাজিত হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারচুপির অভিযোগ এনে তখন এই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর ‘বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে’।
ম্যাকার্থির বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের এই বিদ্রোহ কেবল ব্যক্তিগত বিরোধের জায়গাতেই সীমাবদ্ধ নেই। এখানে মতাদর্শিক বিষয়ও রয়েছে।
বিদ্রোহীরা কেন্দ্রীয় সরকারের আকার, কাজ ও কাজের পরিধিকে ব্যাপকভাবে সীমিত করতে চান। আর কংগ্রেস এই কাজটি যাতে সহজভাবে করতে পারে, সেভাবেই কংগ্রেসের কার্যপ্রণালীতে সংস্কার আনতে চান।
কট্টরপন্থীদের ভোট পেতে কয়েকটি বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন ম্যাকার্থি। এমন কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে তিনি সায় দিয়েছেন যাতে স্পিকারের ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়বে। অথচ আগে এ ধরনের পদক্ষেপ সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন এই রিপাবলিকান।
ছাড় দেওয়ার পরও ভিন্নমতাবলম্বীদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হননি ম্যাকার্থি। এখন পর্যন্ত স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ভোট নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।
স্পিকার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটি বড় সুবিধা পাচ্ছেন ম্যাকার্থি। আর সেটা হলো, এখন পর্যন্ত তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো রিপাবলিকান প্রার্থীকে উঠে আসতে দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে হওয়া কয়েক দফা ভোটাভুটিতে কেউই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেননি।
তবে রিপাবলিকানরা অন্য কারও দিকেও ঝুঁকতে পারেন। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন স্টিভ স্কেলিস। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানদের দ্বিতীয় এই শীর্ষ নেতা ম্যাকার্থির ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
প্রতিনিধি পরিষদের অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, স্পিকার পদে কোনো একজন প্রার্থীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ভোটাভুটি চলতে থাকে। স্পিকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিনিধি পরিষদ মূলত একটি অকেজো প্রতিষ্ঠান। এটি কোনো আইন পাস করতে পারে না। এমনকি সদস্যদের শপথও দিতে পারে না।
স্পিকার নির্বাচনে এ ধরনের অচলাবস্থা সচরাচর দেখা যায় না। তবে কংগ্রেসের শুরুর দিকে স্পিকার নির্বাচন নিয়ে বারবার ভোটাভুটির ঘটনা কিছু সময় পরপরই ঘটত। তবে প্রায় সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে গৃহযুদ্ধের আগে। ওই সময় দলগত অবস্থানের মাত্রা এতটা দৃঢ় ছিল না।
প্রতিনিধি পরিষদের পুরোনো নথিপত্র অনুযায়ী, স্পিকার নির্বাচনে একাধিকবার ভোটাভুটির ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ১৪বার। এর মধ্যে ১৮৮৬ সালে স্পিকার নির্বাচনে রেকর্ড ১৩৩বার ভোটাভুটি হয়েছিল।
এরপর ১৯২৩ সালে স্পিকার নির্বাচনের ভোটাভুটিও তিন দিন প্রলম্বিত হয়েছিল। বর্তমান অচলাবস্থাও গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনে গিয়ে ঠেকে। ওই সময় নবম দফা ভোটে ফিনিস জে গ্যারেটকে ২১৫-১৯৭ ভোটে পরাজিত করে স্পিকার হয়েছিলেন গিলেট।
ওই সময়কার অচলাবস্থার অবসান চলতি বছরের সংস্করণের চেয়ে তুলনামূলক তাড়াতাড়িই হয়েছিল। গতকাল ১১তম বারের মতো ভোটাভুটি হলেও এখন পর্যন্ত স্পিকার পায়নি প্রতিনিধি পরিষদ।