কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

এবার ব্যবধান বাড়াতে মরিয়া কমলা-ট্রাম্প

মার্কিন নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৪৫ দিন। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প আদাজল খেয়ে নেমেছেন জনসমর্থনের কাঁটাটা সামান্য হলেও নিজেদের দিকে হেলাতে। কিন্তু কাঁটা হেলছে না। দুই সপ্তাহ ধরে জনমত জরিপে এই দুই প্রার্থী কার্যত একই জায়গায় আটকে আছেন। উভয়ের চলতি অবস্থা ৫০–৫০।

ছয় সপ্তাহ আগে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যোগ দেওয়ার পর কমলা ভোটের খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর জয়ের ব্যাপারে নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা এখনো পুরোপুরি আস্থাবান নন। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নামজাদা জনমত জরিপকারী হলেন নেইট সিলভার। কয়েক দিন আগে তিনি জানিয়েছিলেন, ভোট হলে কমলা নয়, ট্রাম্পই জিতবেন। বস্তুত সিলভারের হিসাব অনুযায়ী, নভেম্বরে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা ৬৪ শতাংশ।

সেখানে কমলার সম্ভাবনা মাত্র ৩৫ শতাংশ। বলাই বাহুল্য, সিলভারের এই ভবিষ্যদ্বাণীতে ডেমোক্র্যাট সমর্থকেরা অসন্তুষ্ট। আত্মপক্ষ সমর্থন করে সিলভার অবশ্য বলেছেন, সব তথ্য-উপাত্ত মাথায় রেখেই তিনি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁর ধারণা, ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটন যেমন মোট ভোটের হিসাবে অনেক এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটে পরাস্ত হন, কমলার ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটতে পারে।

নানা মহলের সমালোচনার শিকার হয়ে, অথবা নতুন উপাত্ত হাতে পেয়ে নেইট সিলভার অবশ্য তাঁর মত বদলেছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে সফল বিতর্কের পর সামান্য হলেও কমলার জনসমর্থন বেড়েছে। সে উপাত্তের ভিত্তিতে সিলভারের নতুন নির্বাচনী মডেলে এই মুহূর্তে কমলা ও ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা ৫০–৫০।

ইলেকটোরাল ভোট কী ও কেন সে কথা আমরা ইতিপূর্বে জানিয়েছি। নির্বাচনের যে চিত্র ক্রমে পরিষ্কার হয়ে আসছে তা হলো, জিততে হলে কমলা বা ট্রাম্পকে পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে জয় পেতে হবে। ২০২০ সালে বাইডেন প্রথাগত ডেমোক্র্যাট প্রধান অঙ্গরাজ্য ছাড়াও এই তিন ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ (কে জিতবে নিশ্চিত নয়) অঙ্গরাজ্য জিতেছিলেন। জিততে হলে কমলাকেও একই ফল অর্জন করতে হবে।

সম্ভাব্য বিকল্প হলো দক্ষিণের চারটি ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্য—নেভাদা, অ্যারিজোনা, জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনায় জয় নিশ্চিত করা। এই চার অঙ্গরাজ্যেই কমলা ও ট্রাম্পের চলতি অবস্থান সমানে সমান। ডেমোক্র্যাটদের বিশ্বাস, সব কটিতে না হোক, এর দুটি বা তিনটিতে তাঁদের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা বলছেন, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ার সঙ্গে ট্রাম্প যদি পেনসিলভানিয়ায় জয় নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলেই হোয়াইট হাউসে তাঁর পুনঃপ্রবেশ অনিবার্য।

সবার চোখ পেনসিলভানিয়ায়

সংগত কারণেই এই মুহূর্তে সব লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু পেনসিলভানিয়া, যার থলিতে রয়েছে ১৯টি ইলেকটোরাল ভোট। সদ্য পাওয়া জরিপ অনুসারে এখানে কমলা ও ট্রাম্পের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে। মাঠ দখলের জন্য তাঁরা উভয়েই ঘন ঘন নির্বাচনী প্রচারে আসছেন এই অঙ্গরাজ্যে। ২০০৮ সালের মন্দাবস্থা ও ২০১৯-২০ সালের কোভিড–বিপর্যয় এই অঙ্গরাজ্যের অর্থনীতিকে ভারি কাবু করে দিয়েছে। এর কয়লাখনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খাতে এসেছে স্থবিরতা। অনেকেই খোলামেলাভাবে চলতি দুর্যোগের জন্য বাইডেন প্রশাসনকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, অবস্থা বদলাতে ট্রাম্পকে চাই।

অর্থনীতি প্রশ্নে পেনসিলভানিয়াবাসীর এই মনোভাব বদলাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন কমলা। নারী ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তিনি আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারলেও শ্বেতাঙ্গ পুরুষ, বিশেষত যাঁদের কলেজ ডিগ্রি নেই, তাঁরা এখনো ট্রাম্পের নেতৃত্বে আস্থাশীল। কমলা নিজেকে শ্রমিকবান্ধব হিসেবে পরিচয় করালেও দেশের অন্যতম প্রধান শ্রমিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব টিমস্টারস তাঁকে অনুমোদন করতে অস্বীকার করেছে। এই সংগঠনের প্রধান জানিয়েছেন, তাঁরা ট্রাম্পকেও অনুমোদন করছেন না, যদিও তাঁর সংগঠনের প্রতি দশজনের ছয়জন ট্রাম্পের দিকে হেলে আছেন।

খেলা এখন ‘টাই’

পেনসিলভানিয়ার অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের একটি বড় ভরসা ‘ফ্রাকিং’ পদ্ধতি। কমলা একসময় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর—এই যুক্তিতে গ্যাস ও তেল উত্তোলনের এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু এখন বলছেন, তিনি ফ্রাকিংয়ের পক্ষে। ফ্রাকিং নিয়ে এই মত পাল্টানোকে ট্রাম্প ‘ফ্লিপ-ফ্লপিং’ নামে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ, কমলা চটি জুতার একবার এ পা, আবার অন্য পা চালাচালি করছেন। উত্তরে কমলা জানিয়েছেন, অবস্থান বদলালেও তাঁর মূল্যবোধের কোনো পরিবর্তন হয়নি, তিনি এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বাসী।

পেনসিলভানিয়ার জনমত জরিপ থেকে ঠাহর করা কঠিন কমলার এই ব্যাখ্যা কতটা গৃহীত হয়েছে। বুধবার ওয়াশিংটন পোস্ট–এ প্রকাশিত সর্বশেষ জনমত জরিপ অনুসারে, সম্ভাব্য ও তালিকাভুক্ত এমন ভোটারদের মধ্যে কমলা ট্রাম্পের চেয়ে মাত্র ১ পয়েন্টে এগিয়ে। ফুটবলের ভাষায়, খেলা এখন ‘টাই’।

বাঁকা পথে রিপাবলিকান পার্টি

সরাসরি ভোটে হারাতে না পারলে ট্রাম্প যাতে বাঁকা পথে জিততে পারেন, ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যগুলোর রিপাবলিকান নেতৃত্ব তার ফাঁকফোকর খুঁজছেন। যেমন জর্জিয়ায় নির্বাচন শেষে ভোট গণনার সত্যায়ন বা সার্টিফিকেশনের ক্ষেত্রে নতুন আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। এই পরিবর্তন গৃহীত হলে যেকোনো সার্টিফিকেশন বোর্ডের মাত্র একজন সদস্যের আপত্তির মুখে ভোট শেষে সত্যায়ন বিলম্বিত হতে পারে, ফলে যথাসময়ে নতুন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন বাধাগ্রস্ত হবে।

অ্যারিজোনায় নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে প্রায় এক লাখ ভোটারের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র তাদের কাছে নেই। অনেকেই শুধু ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে ভোটার হয়েছেন, কিন্তু নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র জমা দেননি। নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া না গেলে তাঁরা সবাই ভোটদানে অক্ষম হবেন। নির্বাচনের দুই মাস আগে এমন সিদ্ধান্তকে ডেমোক্র্যাটরা একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।

নর্থ ক্যারোলাইনায় ঘটেছে আরেক কাণ্ড। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়রের নাম ব্যালট পেপারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করে ব্যালট পেপার থেকে নিজের নাম প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। ইতিমধ্যে নাম প্রত্যাহারের তারিখ পার হয়ে গেছে। শুধু তা–ই নয়, তাঁর নাম রেখে ব্যালট পেপার ছাপাও হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে সে অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান-প্রভাবিত সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত আইন লঙ্ঘন করে রবার্ট কেনেডির নাম বাদ দিয়ে নতুন করে ব্যালট ছাপানোর আদেশ দিয়েছেন।

এতসব কাণ্ডের একমাত্র কারণ, টিকাবিরোধী হিসেবে পরিচিত কেনেডির নাম ব্যালটে থাকলে রক্ষণশীল ভোটাররা ট্রাম্পের ভোট কাটবেন। মাত্র কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে যে অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারিত হতে পারে, সেখানে কেনেডির নাম বাদ দিলে ট্রাম্পের সুবিধা হয়।

২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের সমর্থকদের একটা চেষ্টা ছিল ভোট গণনার সত্যায়ন অস্বীকার করা। জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি সাতটি ব্যাটলগ্রাউন্ড অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী বোর্ডে কমপক্ষে ২৩০ জন প্রতিনিধির মনোনয়ন দিয়েছে, যারা গত নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করেছিল। কমলাকে ভোটে হারাতে না পারলে এই ‘নির্বাচন অস্বীকারকারী’রা চাতুরীর আশ্রয় নেবে, সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এসব কাণ্ড দেখেশুনে বলতে ইচ্ছা করছে, ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!