আটলান্টিকের তলদেশে নিখোঁজ সাবমেরিনের চালক সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা গেল

ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সাবমেরিন ‘টাইটানের’ চালক স্টকটন রাশ
ছবি: সংগৃহীত

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে পর্যটক নিয়ে নিখোঁজ সাবমেরিনটির এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। সাবমেরিন ‘টাইটানের’ ভেতরে থাকা যাত্রীদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে সবার আগ্রহ। মোট পাঁচজন যাত্রী ছিলেন সাবমেরিনটিতে। তাঁদের মধ্যে সাবমেরিন কোম্পানি ওশানগেটের মালিক স্টকটন রাশও আছেন। তিনি চালকের আসনে ছিলেন।

প্রকৃতিপ্রেমী ও দুঃসাহসিক হিসেবে স্টকটন রাশের পরিচিতি আছে। গভীর সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করার অদম্য উৎসাহ তাঁর। পাশাপাশি নিয়ম মানার প্রতি রয়েছে চরম অনীহা।

গত বছর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যমে সিবিএসের সাংবাদিক ডেভিড পগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাশ বলেছিলেন, ‘কখনো কখনো নিরাপত্তা মানে অপচয়। আমি বোঝাতে চাচ্ছি, আপনি যদি নিরাপদ থাকতে চান, তবে বিছানা থেকে উঠবেন না, গাড়িতে উঠবেন না। অর্থাৎ আপনি কোনো কিছুই করবেন না’

স্টকটন রাশ ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাকাশ প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি নেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসনিয়ান সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ছোটবেলায় কখনো মহাকাশচারী হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি তিনি। কারণ, তাঁর দৃষ্টিশক্তি যথেষ্ট ভালো ছিল না।

স্নাতক শেষ করার পর ম্যাকডোনেল ডগলাস করপোরেশনে ফ্লাইট টেস্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে চলে যান স্টকটন রাশ। ১৯৮৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (বার্কলে) থেকে এমবিএ ডিগ্রি নেন।

দীর্ঘদিন ধরেই মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন লালন করছিলেন রাশ। পর্যটক হিসেবে একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে মহাকাশে যাওয়ার কথা ভাবতেন তিনি। কিন্তু ২০০৪ সালে মহাকাশ ভ্রমণের জন্য উড়োজাহাজ তৈরির ঘোষণা দেন ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন। ওই ঘোষণার পর নিজের মত পাল্টান রাশ।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাবমেরিন সরবরাহকারী কোম্পানি ওশানগেট নিখোঁজ সাবমেরিন ‘টাইটান’ পরিচালনা করে

নতুন কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৯ সালে ওশানগেট প্রতিষ্ঠা করেন রাশ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, উদ্ভাবনের মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে বিচরণ বাড়ানো। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে তাঁর কাজ ছিল, আর্থিক ও প্রকৌশল শাখা নিয়ে পরিকল্পনা করা। পাশাপাশি সাবমেরিনের নাবিকদের উন্নয়নের জন্য নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করা।

ওশানগেট বর্তমানে গবেষণা, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং ভ্রমণের জন্য তিনটি সাবমেরিন পরিচালনা করে। এর মধ্যে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে আটলান্টিকের তলদেশে ১৩ হাজার ফুট গভীরে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয় একটি সাবমেরিনে। আট দিনের এই ভ্রমণে প্রতিটি আসনের জন্য আড়াই লাখ ডলার (আড়াই কোটি টাকার বেশি) খরচ করতে হয়।

৬১ বছর বয়সী রাশ বলেছিলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে আকাশের চেয়ে সমুদ্র মানুষকে বেঁচে থাকার সেরা সুযোগ দেয়। তিনি আরও বলেন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ পানির নিচে, মঙ্গল গ্রহে নয়।

ওশানগেটের নিরাপত্তা সম্পর্কে কর্মচারীদের সতর্কতা উপেক্ষা ও অবহেলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে রাশের বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ডিরেক্টর অব মেরিন অপারেশন ডেভিড লোচরিজ এ নিয়ে আদালতে একটি মামলা করেছিলেন। মামলার অভিযোগে তিনি বলেছেন, টাইটানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় ২০১৮ সালে তাঁকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।

ওশানগেটের আরেকজন সাবেক কর্মচারী, নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তাঁর বক্তব্যেও লোচরিজের উদ্বেগের মিল পাওয়া যায়। তিনি জানান, বৈঠকের সময় রাশ রক্ষণাত্মক হয়ে ওঠেন এবং কর্মীদের প্রশ্ন এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে ওশানগেটের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি প্রতিষ্ঠানটি।

গত রোববার আটলান্টিকের তলদেশে হারিয়ে যাওয়ার পর সাবমেরিনটির নকশা এবং অন-বোর্ড প্রযুক্তির কিছু দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত বছর সিবিএসের সাংবাদিক ডেভিড পগ টাইটানে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, সেবার সমুদ্রের তলদেশে যাত্রার একপর্যায়ে টাইটানের সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সেটি সমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল। ওই ঘটনার পর টাইটানের যন্ত্রপাতি সম্পর্কে রাশকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি।

গতকাল বুধবার এক সাক্ষাৎকারে ডেভিড পগ বলেন, টাইটানের কিছু কিছু ব্যালাস্ট পুরোনো হয়ে গিয়েছিল। পাইপগুলো ছিল মরিচা ধরা।