শিখ আন্দোলনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন
শিখ আন্দোলনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুন

শিখ নেতা পান্নুন হত্যাচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কে কতটা প্রভাব ফেলবে

ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শিখ সম্প্রদায়ের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যা করতে ভারতীয় এক কর্মকর্তা নির্দেশনা দিয়েছেন। মার্কিন সরকারি কৌঁসুলিরা গতকাল বুধবার এমনই অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় ভারতীয় এক নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অবশ্য মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এমন অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের সম্পর্কে এর প্রভাব কতটা, সেটা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বলে দেবে।

পান্নুন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডারও নাগরিক। তিনি নিউইয়র্কে বসবাস করতেন। তিনি ভারতে স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনের জোরালো সমর্থক। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নানাভাবে জড়িত তিনি। ভারত সরকার তাঁকে সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।  

এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নিতে জনগণ এবং ক্যাপিটল হিল থেকে বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ এলে তবে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে
মাইকেল কুগেলম্যান, উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক

ফেডারেল কৌঁসুলিরা বলছেন, নিউইয়র্কে শিখ নেতাকে হত্যা করতে ভারতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে কাজ করেছেন ভারতীয় নাগরিক (৫২) নিখিল গুপ্ত।

গতকাল বুধবার মার্কিন ফেডারেল কৌঁসুলি অবশ্য অভিযোগপত্রে ভারত সরকারের ওই কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেননি বা অভিযোগপত্রে তাঁর নাম–পরিচয়ও প্রকাশ করা হয়নি। অভিযোগপত্রে তাঁকে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্বে থাকা ‘জ্যেষ্ঠ মাঠ কর্মকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আগে ভারতের সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সে কাজ করেছেন।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে প্রভাব

এর আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক খালিস্তান আন্দোলনের এক নেতাকে হত্যায় ভারতের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এবার যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আরেক শিখ নেতাকে হত্যাচেষ্টায় ভারতের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা।

গতকাল বুধবার পান্নুনকে হত্যাচেষ্টা সংক্রান্ত সে অভিযোগপত্র প্রকাশ হওয়ার আগে ভারত একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র নিয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানোর পর এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

ফেডারেল কৌঁসুলিরা বলেন, গত ৩০ জুন চেক প্রজাতন্ত্রে নিখিল গুপ্ত গ্রেপ্তার হন। যুক্তরাষ্ট্র ও চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তাঁকে কখন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরানো হবে এবং সেখানে তাঁর পক্ষে লড়ার জন্য আইনজীবী ঠিক করা হয়েছে কিনা, তা তাৎক্ষণিক জানা যায়নি।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব ঠেকাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, তখন এ মামলাটিকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।

সুলিভান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়তা চায়, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। যদি আবার এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন, চীনকে মোকাবিলায় ওয়াশিংটন যেহেতু ভারতকে কৌশলগত সহযোগী করতে চাইছে, তখন দ্বিপক্ষীয় এ সংকটের সমাধান করা যেতে পারে।

কুগেলম্যান বলেন, ‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওয়াশিংটন যখন নিজেদের মাটিতে হত্যাচেষ্টার জন্য বিদেশি সরকারকে অভিযুক্ত করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে সংকট তৈরি হয়। তবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশেষ দিক আছে। এটা লক্ষণীয় যে প্রশাসন বিষয়টি জানার পরও ভারতের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ কমেনি। উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলো নির্ধারিত সময়েই হচ্ছে।’

কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘এ ব্যাপারে শক্ত পদক্ষেপ নিতে জনগণ এবং ক্যাপিটল হিল থেকে বাইডেন প্রশাসনের ওপর চাপ এলে তবে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’

নিখিল গুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে হোয়াইট হাউস। তবে তারা বলেছে, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে।

গতকাল বুধবার বার্তা সংস্থা এপিকে ফোনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন পান্নুন। তিনি বলেন, ‘শারীরিক মৃত্যু নিয়ে আমি ভীত নই। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচার চালাতে গিয়ে আমাকে যদি এমন মূল্য দিতে হয়, তবে সে মূল্য চোকাতে আমি রাজি আছি।’
পান্নুন আরও দাবি করেছেন, নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে গিয়ে তারা কখনো সহিংস কর্মকাণ্ড চালাননি।

নিখিল গুপ্তের বিরুদ্ধে পান্নুনকে হত্যার জন্য পেশাদার খুনি ভাড়া করা এবং হত্যার ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ আনা হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর ২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, মে মাসে ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা (নাম-পরিচয় জানা যায়নি) পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা সাজাতে গুপ্তকে নিয়োগ দেন। আদালতের নথিতে পান্নুনকে ‘ভুক্তভোগী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড সংঘটনের জন্য একজন পেশাদার খুনিকে ভাড়া করতে গুপ্ত এক অপরাধীর সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু ওই সহযোগী আসলে মার্কিন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যামিনিস্ট্রেশনের (ডিইএ) ‘আন্ডার কভার এজেন্ট’ সূত্র হিসেবে কাজ করতেন। ওই সূত্র তখন গুপ্তকে কথিত পেশাদার খুনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ওই খুনিও আসলে ডিইএর একজন এজেন্ট।

জুনে নিখিল গুপ্তকে শিখ নেতা পান্নুনের বাড়ির ঠিকানা, তাঁর ফোন নম্বর এবং তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্মের বিস্তারিত জানান ভারতের ওই সরকারি কর্মকর্তা। নজরদারি ক্যামেরায় ধারণ করা পান্নুনের ছবিও গুপ্তকে দেওয়া হয়েছিল। গুপ্ত তথ্যগুলো ডিইএর সেই এজেন্টকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, যত দ্রুত সম্ভব হত্যাকাণ্ড চালাতে ওই চোরাগোপ্তা এজেন্টকে নির্দেশ দিয়েছিলেন গুপ্ত।  

জুলাই থেকে তৎপরতা শুরু

বাইডেন প্রশাসনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, হোয়াইট হাউস প্রথম গত জুলাইয়ে শিখ নেতা পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষ অজিত দোভালের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করেছেন। তিনি দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে দোভালের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। সুলিভান আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়তা চায়, এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। যদি আবার এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সিআইএর পরিচালক উইলিয়ামস বার্নসকে তাঁর ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি সিআইএ পরিচালককে ভারতে গিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে বলেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করবে না।

গত সেপ্টেম্বরে নয়াদিল্লিতে জি–২০ সম্মেলনের এক ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠককালে বাইডেন বিষয়টি তুলেছিলেন।  

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও জ্যাক সুলিভান গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছে এই হত্যাচেষ্টার ঘটনা উত্থাপন করেন।
গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক অ্যাভ্রিল হেইনস ভারত সফর করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ তদন্তে সহযোগিতা করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান।

এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন অ্যাটর্নি এবং ম্যানহাটনের প্রধান ফেডারেল কৌঁসুলি ড্যামিয়ান উইলিয়ামস বলেন, ‘আসামি ভারত থেকে নিউইয়র্কে এসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিককে হত্যার পরিকল্পনা করেছে। ওই মার্কিন নাগরিক শিখদের জন্য একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচার চালাতেন।’

বিজ্ঞপ্তিতে উইলিয়ামস আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে মার্কিন নাগরিকদের হত্যার ষড়যন্ত্র আমরা সহ্য করব না। এখানে কিংবা বিদেশে যারা মার্কিন নাগরিকদের ক্ষতি করতে চাইবে, কণ্ঠরোধ করতে চাইবে—তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে, তাদের প্রতিহত করতে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে আমরা প্রস্তুত আছি।’