যদি প্রশ্ন করা হয়, এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান পার্টির উদীয়মান নেতা কে? সবাই একবাক্যে রন ডিস্যান্টিসের নামই বলবেন। ট্রাম্পের জামানায় ট্রাম্পবাদকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন তিনি। রিপাবলিকানরা এখন ট্রাম্পকে ছাড়াই রন ডিস্যান্টিসের মধ্যে ট্রাম্পবাদ খুঁজতে শুরু করেছেন। কী এমন জাদু করেছেন ডিস্যান্টিস? উত্তরটা ট্রাম্পের হাবভাবেই বুঝে যাওয়ার কথা। রন ডিস্যান্টিসকে নিয়ে ট্রাম্প বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই পড়েছেন। তাঁর দল থেকে উঠে এসে ডিস্যান্টিস যে এখন তাঁরই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী।
রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন কিছু নয়। তবে ট্রাম্পকে রিপাবলিকান নেতা হিসেবে সহজে কেউ টলাবে, তা এই কিছুদিন আগেও বোধ হয় সহজে ধারণা করা সম্ভব ছিল না। তবে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস যে জনপ্রিয়তা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে টক্কর দিতে যাচ্ছেন, তাতে ট্রাম্পকে বিপদের মুখে পড়তে হতে পারে। ইউএসএ টুডে ও সাফোক ইউনিভার্সিটির এক নতুন জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে বড় ব্যবধানে এগিয়ে গেছেন ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস। নতুন এক জরিপে সাবেক প্রেসিডেন্টের চেয়ে ২৩ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন তিনি। আর এই জরিপের ফল নিয়ে ট্রাম্পের অস্বস্তিতে পড়াই স্বাভাবিক।
ডিস্যান্টিস যে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে এগিয়ে আসতে যাচ্ছেন, তা তিনি আগেই টের পেয়েছিলেন। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে ২০২৪ সালে। সেই নির্বাচনে আবারও রিপাবলিকান পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে চান সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই নির্বাচনে যেন দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে শামিল না হন, সে জন্য দলের আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী রন ডিস্যান্টিসকে রীতিমতো হুমকিও দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই ভীতির কারণ ডিস্যান্টিসের জনপ্রিয়তা। ফ্লোরিডার গভর্নর পদে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি জনপ্রিয়তা বাড়ার প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁকে হুমকি দিয়ে ট্রাম্প বলেই ফেলেছেন, ‘ডিস্যান্টিস যদি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা করেন, তবে নিজের বড় ক্ষতি করবেন। আমি মনে করি না যে এটা দলের জন্য ভালো কিছু হবে।’ ফ্লোরিডার এই গভর্নর সম্পর্কে তাঁর কাছে এমন কিছু তথ্য আছে, যেগুলো ‘যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক’ হবে না বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প।
তবে ট্রাম্পের হুমকিকে পাত্তা দিচ্ছেন না ডিস্যান্টিস। অন্তত তাঁর জনপ্রিয়তা এসব হুমকি ঠেলে এগিয়ে যেতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। জরিপের ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘটছে। জরিপে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৪৭-৪০ শতাংশ ব্যবধানে ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন। আর রন ডিস্যান্টিস ৪৭-৪৩ শতাংশ ব্যবধানে বাইডেনের চেয়ে এগিয়ে আছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি শেষ হওয়া মধ্যবর্তী নির্বাচনে ৪৪ বছর বয়সী ডিস্যান্টিস রীতিমতো ঝড় তুলেছেন। এতে তিনি রিপাবলিকানদের সবচেয়ে বড় উদীয়মান তারকায় পরিণত হয়েছেন এবং ট্রাম্পের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে দলের প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে জোরালো দাবিদার এখন তিনি।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার জন্য ডিস্যান্টিস প্রস্তুত কি না, তা নিয়ে। তিনি এখনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চান কি না, তার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি। তিনি বলেছেন, আপাতত গভর্নরের দায়িত্বেই তিনি মনোযোগ দিতে চান। তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার প্রশ্ন এড়িয়ে চলছেন।
কিন্তু যতই প্রশ্ন এড়িয়ে চলুন না কেন, ডিস্যান্টিসের প্রস্তুতি কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য কারেজ টু বি ফ্রি’ আগামী বছর মুক্তি পাচ্ছে। প্রকাশকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এটা সেই মানুষের গল্প, যিনি লড়াই করে যুদ্ধের পর যুদ্ধ জিতেছেন। তিনি শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিরোধীদের হারাননি, তিনি গণমাধ্যমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও লড়েছেন।’
ডিস্যান্টিস তাঁর গভর্নর পদে নির্বাচনী লড়াই চালানোর জন্য ২০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে এক কোটি ডলার তিনি পেয়েছিলেন লাস ভেগাসের এক আবাসন ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই। তিনি যে তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এখনো তাঁর ব্যাংকে ৯ কোটি ডলারের বেশি রয়ে গেছে। এখনো তিনি তহবিল সংগ্রহ করছেন। তাঁর ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারের কারণেই ঢাকা পড়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী শার্লি ক্রিস্ট।
ডিস্যান্টিস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। ফ্লোরিডায় কীভাবে ভোট করতে হয়, তা দেখিয়ে দিয়েছি। আমরা এখানে ফ্লোরিডার ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। একসময় ফ্লোরিডাকে সুইং স্টেট ধরা হলেও এখন তা রিপাবলিকানদের ঘাঁটি বলাই যায়।’
রিপাবলিকান পার্টির গণমাধ্যম পরামর্শক জিয়ানকার্লো সোপো বলেন, গভর্নর নির্বাচনে ডিস্যান্টিসের ব্যাপক জয় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়িয়েছে। তিনি জানেন কীভাবে রিপাবলিকান ভোটারদের জাগিয়ে তুলতে হয়। তিনি রিপাবলিকানদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র ও ডেমোক্র্যাটদের ভোটও টেনেছেন।
জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও এখনো কেন ডিস্যান্টিস ট্রাম্পের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছেন না, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম এনপিআর এর তিনটি কারণ তুলে ধরেছে। প্রথমটি হচ্ছে গভর্নর থেকে ডিস্যান্টিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে পারবেন না। ফ্লোরিডার আইন অনুযায়ী, নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাঁকে পদ ছাড়তে হবে।
এ ছাড়া রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে ডিস্যান্টিসের বেশ কিছু রক্ষণশীলতার দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি করোনা মহামারির সময় টিকা ও মাস্কের বিরুদ্ধে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি রক্ষণশীল নীতির সমর্থন দিয়েছেন। ১৫ সপ্তাহের পর গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার একটি আইনও অনুমোদন করেছিলেন তিনি। এসব নীতির কারণে তিনি ফক্স নিউজের নিয়মিত মুখ।
ট্রাম্পের হুমকি নিয়ে সরাসরি কোনো কথা বলেন না ডিস্যান্টিস। তিনি বলেন, এগুলো কেবল কথার কথা। তিনি কোনো বক্তৃতায় ট্রাম্পের নামও নেন না। উত্তর ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল বাইন্ডারের মতে, ডিস্যান্টিস মূলত ট্রাম্প হয়ে উঠতে চান। তবে তিনি ট্রাম্পের মতো অসংলগ্ন কথাবার্তা, টুইটারের লড়াই বা ব্যক্তি আক্রমণ থেকে দূরে থাকার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেন।
ডিস্যান্টিসের এখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নামার ঘোষণা না দেওয়ার আরেকটি কারণ বলেছেন মাইকেল বাইন্ডার। তিনি বলেন, এখনই দলীয় কোন্দল চান না ডিস্যান্টিস। যদি এখনই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেন, তবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর লড়াই শুরু হবে। বর্তমানে গভর্নর হিসেবে তিনি ট্রাম্পকে উপেক্ষা করেই বিভিন্ন দাতার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এমনকি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে গিয়ে ভোটের প্রচার করতে পারেন।
ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাইকেল ম্যাকডোনাল্ড মনে করেন, ডিস্যান্টিস ব্যক্তিগত আক্রমণের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করতে পছন্দ করেন। এটাই তাঁকে ট্রাম্পের থেকে আলাদা করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তর অঙ্গরাজ্যের গভর্নর পদটি ডিস্যান্টিসের জন্য অনেক কিছু। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করলে তিনি আরও আলোচনায় আসবেন। কিন্তু প্রকৃত সমস্যা হলো, এখনো ট্রাম্পের মতো ততটা পরিচিত নন ডিস্যান্টিস। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাইন্ডার বলেন, ডিস্যান্টিস বিতর্কে পারদর্শী নন। ২০ হাজারের বেশি মানুষের জনসভাকে তিনি জাগিয়ে তুলতে পারেন না।
ডিস্যান্টিসের সমর্থকদের জন্য আরেকটি সতর্কবার্তা জেনে রাখা ভালো। তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট পদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা ব্যক্তির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় না। উদাহরণ হিসেবে উইসকনসিনের সাবেক জনপ্রিয় গভর্নর স্কট ওয়াকারের কথা বলা যেতে পারে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনিই এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁকে ছাপিয়ে যান ট্রাম্প। এখন ডিস্যান্টিস ও ট্রাম্পের মধ্যে কে রিপাবলিকান পার্টি থেকে সামনে আসবেন, সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব।
এএফপি, রয়টার্স ও এনপিআর অবলম্বনে