রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশে গুলি চলার পর দর্শকদের বসার জায়গায় রক্তাক্ত সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ শুয়ে পড়ে নিজেকে গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। ১৩ জুলাই, ২০২৪ বাটলার, পেনসিলভানিয়া
রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশে গুলি চলার পর দর্শকদের বসার জায়গায় রক্তাক্ত সমর্থকদের দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ শুয়ে পড়ে নিজেকে গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। ১৩ জুলাই, ২০২৪ বাটলার, পেনসিলভানিয়া

প্রথমে আতঙ্ক, তারপর ক্ষোভ: এটা ‘যুদ্ধ’ ‘গৃহযুদ্ধ’

কখনো কখনো শব্দ মানুষকে ভীষণভাবে বিভ্রান্ত করে। আতশবাজির শব্দে আমরা চমকে উঠি। কিন্তু পেনসিলভানিয়ার বাটলার ফার্মে গত শনিবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশে হঠাৎ শব্দ শুনে উপস্থিত সবাই বুঝতে পেরেছিলেন, গুলি চলছে এবং চলছেই।

ট্রাম্পের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে সেদিন বিবিসির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক (নর্থ আমেরিকা) গ্যারি ও’ডনোগু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বর্ণনায় ট্রাম্পের সমাবেশে গত শনিবার সন্ধ্যায় যে আতঙ্ক ও ক্ষোভের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা উঠে এসেছে।

সবে মঞ্চে উঠে বক্তব্য দিতে শুরু করেছিলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ট্রাম্প। হঠাৎই গুলির শব্দ, ট্রাম্প তাঁর ডান কান চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েন। সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা রক্তাক্ত ট্রাম্পকে ঘিরে ধরে সরিয়ে নেন।

ও’ডনোগু বলেন, ‘গুলি কোথা থেকে চলছে, শুরুতে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। তবে আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, বন্দুকধারী সেখান থেকে সম্ভবত ১৫০ মিটার দূরে ছিল, একটি বাড়ির ছাদে লম্বা হয়ে শুয়ে একটি এআর–১৫ রাইফেল দিয়ে তিনি ট্রাম্প ও আতঙ্কিত দর্শকদের দিকে অন্তত ছয়টি গুলি ছোড়েন।’
গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ও’ডনোগু এবং তাঁর সঙ্গে থাকা দুই সহকর্মী মাটিতে শুয়ে পড়েন এবং নিজেদের গাড়িকে আড়াল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেন।

আতঙ্কজনক ওই মুহূর্তের বর্ণনায় ও’ডনোগু বলেন, ‘কোথা থেকে গুলি করা হচ্ছে, আমরা তা বুঝতে পারছিলাম না; কতজন বন্দুকধারী সেখানে রয়েছেন, সেটাও না এবং কতক্ষণ ধরে এই গুলি চলবে, সেটাও না। সত্যি বলতে, এটা ছিল ভয়ংকর এক মুহূর্ত।’

নিজেদের সামলে নিয়ে মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থাতেই বিবিসির ক্যামেরাম্যান স্যাম বিটি তাঁর ক্যামেরা চালু করেন। ও’ডনোগু বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে চলমান পরিস্থিতির প্রাথমিক বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদিও তাঁর কাছে ট্রাম্প ছয় মিনিট বক্তব্য দেওয়ার পর গুলি শুরু হওয়ার তথ্য ছাড়া আর কোনো তথ্য ছিল না।

ও’ডনোগু বলেন, ‘আমি চারদিকে মানুষের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। ট্রাম্পের কথা আর শোনা যাচ্ছিল না। তবে কি তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, মারা গেছেন? আমার এসব কথাই মনে হচ্ছিল।’

সেখানে উপস্থিত বেশির ভাগ মানুষই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কাউকে কাউকে স্তব্ধ ও বিভ্রান্ত মনে হচ্ছিল বলে জানান ও’ডনোগু। কেউ কেউ রাগে ফেটে পড়ছিলেন।

কেউ কেউ অনেক বেশি রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া জানান। একজন বিবিসিকে বলেন, ‘তাঁরা প্রথম গুলি করেছে। এটা যুদ্ধ।’ আরেকজন ‘গৃহযুদ্ধ’ বলে চিৎকার করেন।

কয়েক মিনিট পর একটি ট্রাকের এক পাশে বিশাল একটি বৈদ্যুতিক বিলবোর্ডে লেখা ওঠে, ‘ডেমোক্র্যাটরা গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছে...প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।’

ও’ডনোগু বলেন, এটা দেখে তিনি কেঁপে ওঠেন। তাঁর শরীর হিম হয়ে যায়। এ ঘটনার ভয়ংকর পরিণতি কী হতে পারে, তা ভেবে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।

তবে সেখানে আতঙ্ক ও ক্ষোভের পাশাপাশি লোকজন শোকাহতও হয়ে পড়েছিলেন। মনে হচ্ছিল, তাঁরা নিজেদের দেশকে চিনতেই পারছেন না...মনে হচ্ছিল সবকিছুই অচেনা এবং তাঁদের নয়।

নিজের ১৪ বছর বয়সী ছেলে কোলবিকে নিয়ে ট্রাম্পের সমাবেশে এসেছিলেন স্থানীয় কৃষক ডেবিন।

বাবা-ছেলে জুটির জীবনে এটাই ছিল প্রথম কোনো নির্বাচনী সমাবেশে অংশগ্রহণ এবং প্রথমবারেই গণতন্ত্রের এমন রূপ কোলবি দেখেছে, যেখানে গুলিতে গুরুতর আহত দুই ব্যক্তিকে স্ট্রেচারে তুলে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া গুলি চলার পর সিক্রেট সার্ভিসের সদস্যরা যেভাবে বন্দুকধারীকে গুলি করে হত্যা করেছেন, তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্রের নল থেকে বেরিয়া আসা আলোর ঝলক সারা জীবনে কোলবি ভুলতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।

আমেরিকার জনগণ বন্দুক ভালোবাসে। এমনকি পশ্চিম পেনসিলভানিয়ার প্রত্যন্ত ওই অঞ্চলে যাঁরা নিজেদের বন্দুক ও রাইফেলের প্রতি ভালোবাসায় অটল, তাঁরাও শনিবার সন্ধ্যায় যে যথেচ্ছ সহিংসতা দেখেছেন, তাতে তাঁরাও অসুস্থ ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। গুলি চলার পরও তাঁদের রাজনীতির নায়ক ট্রাম্প জীবিত আছেন, এটাও তাঁদের অবাক করছে।

যুক্তরষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে বিতর্ক কয়েক দশক ধরেই চলছে। কিন্তু শনিবার বাটলারে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা ওই বিতর্কের চেয়েও বড় কিছু বলে মনে করেন ও’ডনোগু।

বিবিসির এই সাংবাদিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ক্রমশ এই মুহূর্তের দিকে এগিয়েছে। দেশটিতে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, সেটা এখন আর শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটা বিষাক্ত হয়ে গেছে।

ওই সাংবাদিক বলছিলেন, ‘নাকি আমার এটা বলা উচিত যে কিছু মানুষ তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘৃণা করা অনেক সহজ মনে করছে। এটা তাদের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে; যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ডিএনএতে ঘৃণার বিষয়টি ঢুকে যাচ্ছে।’

ও’ডনোগু আরও বলেন, ‘এটা শুধু রাজনীতিতে নয়। আপনি উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে দেশের মধ্যাঞ্চলের মানুষের ভেতর এই ঘৃণা দেখতে পাবেন। উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে, শহুরে ও গ্রামে বসবাস করা মার্কিনদের মধ্যেও।’