কার্বন নিঃসরণ কমাতে দরকার ‘সুইস আর্মি নাইফ’

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের একজন তিনি। দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতাও তিনি। সম্প্রতি নিজের ওয়েবসাইট গেটস নোটসে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি (ক্লিন এনার্জি) বিষয়ে হাইড্রোজেনের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে লিখেছেন।

বিল গেটস

গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বিষয়টি চিন্তা করলে অধিকাংশ মানুষের মনে আসে গাড়ি ও বিদ্যুতের কথা। তাঁদের এমনটা ভাবার কারণ, রোজ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করতে চাবি ঘোরান তাঁরা, কম্পিউটার চালু করতে বোতাম চাপেন এবং আলো জ্বালতে, পাখা ঘোরাতে বা শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালু করতে সুইসের ব্যবহার করেন। সুখবর হলো, এসব কর্মকাণ্ডে যে কার্বণ নিঃসরণ হয়, তা কমাতে আমরা এরই মধ্যে সৌর, বায়ু ও পারমাণবিক শক্তি এবং লিথিয়াম ব্যাটারির মতো জ্বালানি ব্যবহারের পথে হাঁটতে শুরু করেছি। তবে এখানে উদ্বেগের বিষয় হলো, এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বে মোট কার্বন নিঃসরণের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র কমানোর দিকে যেতে পারব।

বাকি দুই–তৃতীয়াংশ, যার পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টন—কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি ধরতে পারা বেশির ভাগ মানুষের জন্য কঠিন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমরা সবাই সিমেন্ট, প্লাস্টিক ও স্টিলের তৈরি পণ্য ব্যবহার করি, কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ মানুষই এসব পণ্য উৎপাদন করি না বা সেগুলোকে কার্গো জাহাজে তুলে দিই না। এসব পণ্য থেকে কার্বণ নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে আমাদের দরকার নতুন নতুন প্রযুক্তি।

ক্লিন হাইড্রোজেন বা পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন যুগে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। এই ক্লিন হাইড্রোজেনের সম্ভাবনা এতটাই বেশি যে কিছু মানুষ একে কার্বন নিঃসরণ বন্ধের ‘সুইস আর্মি নাইফ’ অভিহিত করতে ভালোবাসেন। (সুইস আর্মি নাইফ এমন একটি চাকু, যাতে একাধিক ব্লেড, কাঁচি, স্ক্রু ড্রাইভারসহ নানা ধরনের সুবিধা থাকে)।

হাইড্রোজেন জ্বালানিচালিত এ গাড়ি তৈরি করেছে হুন্দাই। সুইজারল্যান্ডের লুজার্নের সুইস মিউজিয়াম অব ট্রান্সপোর্টে

কী করতে পারে হাইড্রোজেন

সার উৎপাদনের মতো কিছু পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক হিসেবে বিশ্বে প্রতিবছর সাত কোটি টন হাইড্রোজেন ব্যবহৃত হচ্ছে। এ বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেনের প্রায় সবটাই আসে এখন জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। আমরা যদি এই হাইড্রোজেনকে পরিবেশবান্ধব (ক্লিন) করতে পারি, তাহলে আমরা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ১ দশমিক ৬ শতাংশ কমাতে পারব।

কিন্তু এটা সূচনা মাত্র। হাইড্রোজেন হলো বিশুদ্ধ ও সক্রিয় রাসায়নিক শক্তি। আমরা যদি এর উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমাতে পারি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে এর উৎপাদন করতে পারি, তাহলে সব ধরনের কারাখানাভিত্তিক উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে আমরা ক্লিন হাইড্রোজেন ব্যবহার শুরু করতে পারি। অর্থাৎ প্লাস্টিক ও স্টিল উৎপাদনে, তরল জ্বালানি এমনকি খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব বা ক্লিন হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যাবে (এ কারণে একে ‘সুইস আর্মি নাইফ’ বলা হচ্ছে)।

উপরন্তু, শিল্পকারখানার বাইরেও বহুবিধ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যত বেশি উৎস থেকে যত বেশি বিদ্যুৎ আসতে থাকবে, বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে তত বেশি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা পাবে বিশ্ব। ফলে সূর্য যখন আলো দেবে না বা বাতাস যখন বয়ে যাবে না, তখনো আমরা অন্ধকারে ডুবে যাব না।

ইলেকট্রোলাইসিস নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎকে আমরা হাইড্রোজেনে রূপান্তর করতে পারি। এরপর একে কয়েক মাসের জন্য সংরক্ষণ করতে পারি। আবার যখন বিদ্যুৎ দরকার হবে, তখন ওই হাইড্রোজেনকে বিদ্যুতে রূপান্তর করে ব্যবহার করতে পারব।

বড় পরিসরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও হাইড্রোজেনের চমৎকার ব্যবহার সম্ভব। ব্যাটারিচালিত ও বিদ্যুৎ–চালিত বাহনগুলো যাত্রী পরিবহন ও স্বল্প দূরত্বে মালামাল পরিহবনে দারুণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু আকাশ ও সমুদ্রপথে এবং দীর্ঘ দূরত্বের পথে পণ্য পরিবহন এ ক্ষেত্রে এখনো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক কার্বণ নিঃসরণের ৮ শতাংশই আসছে এখান থেকে। বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে পারে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের জরুরি কাজের অনেক কিছুই পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন ব্যবহারের মধ্য দিয়ে হতে পারে। এ কারণে ইউরোপের অনেক দেশসহ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের অর্থনীতিকে কার্বনমুক্তকরণের জন্য পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন ব্যবহারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বাস্তবে আমরা কীভাবে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে পারি?

কীভাবে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন উৎপাদন

উদ্ভাবকেরা নানাবিধ প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অন্যগুলোর চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ।

একটা উপায় হতে পারে, সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে পানিকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে রূপান্তর। ইলেকট্রোলাইসিস নামের এ প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয় ১৮০০ সালে। এ প্রক্রিয়ায় আলেসান্দ্রো ভোল্টার আবিষ্কৃত ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়েছিল। দুই শতাব্দীর বেশি সময় পর ওই আবিষ্কারের মূল নীতি হতে পারে ব্যাপক মাত্রায় হাইড্রোজেন উৎপাদনের চাবিকাঠি। ইলেকট্রোলাইসিসের জন্য এ পর্যন্ত চার ধরনের প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক কম দামে হাইড্রোজেন উৎপাদনে এর প্রতিটির ক্ষেত্রে খরচ কম হতে হবে।

হাইড্রোজেন তৈরির আরেকটি উপায় হতে পারে বিদ্যমান প্রক্রিয়ার ব্যবহার। অর্থাৎ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন কার্বন ডাই–অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নিঃসরণের সুযোগ না দিয়ে আটকে রাখা। যদিও বিদ্যমান প্রযুক্তিতে শতভাগ কার্বন পরিশোধন হয়তো কখনোই সে রকম আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হবে না। কিন্তু যত দিন আমাদের হাজার হাজার শিল্পকারখানার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তত দিন এটা করা যায়। এতে কার্বন নিঃসরণ নিম্নমুখী হবে।

অন্যান্য প্রযুক্তি এখনো অনেক দূরে

বর্তমানে হাইড্রোজেন উৎপাদনে প্রাথমিক জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে মিথেন ব্যবহার করা হয়। এটা যখন উচ্চ তাপমাত্রায় পানির (H2O) সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তখন হাইড্রোজেন ও কার্বন ডাই–অক্সাইড উভয়ই উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে পাইরোলিসিস নামের আরেকটি তাপীয় পদ্ধতি রয়েছে, যা অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে ঘটে। এর মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণুকে আলাদা করা যায়, পড়ে থাকে শুধু নিরেট কার্বন। পেনসিলের ডগায় যেমনটি থাকে।

আর শেষ কথা হলো বিশ্বজুড়ে ভূতাত্ত্বিক গঠনগত জায়গা থেকে হাইড্রোজেনের মজুত রয়েছে। এখান থেকে কার্বন নিঃসরণ ছাড়াই বিপুল পরিমাণে হাইড্রোজেন পাওয়া সম্ভব, যা অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী হবে। প্রাকৃতিক মজুত থেকে কীভাবে হাইড্রোজেন পাওয়া যায়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। তবে এ গবেষণা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

যেভাবে সাশ্রয়ী করা যায়

পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেনের বিষয়টি আশা জাগাচ্ছে এবং প্রতিদিনই এর প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হচ্ছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিষয়টিই ধরা যাক। এ যুদ্ধ হাইড্রোজেনকে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় হিসেবে নয়, জ্বালানি নিরাপত্তার দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এরই মধ্যে ২০৩০ সাল নাগাদ দুই কোটি টন পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন উৎপাদন ও আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। এতে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর তাদের নির্ভরতা অন্তত এক–তৃতীয়াংশ কমবে।

তবে অন্য সব পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মতো হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা কি এর খরচ অনেকটা কমিয়ে আনতে পারব, তা কি খুব দ্রুততার সঙ্গে ঘটবে? পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির জন্য জনসাধারণকে যদি অনেক বেশি পয়সা গুনতে হয়, তাহলে পরিবর্তনের গতি হবে খুবই ধীর।

আমরা যদি গ্রিন প্রিমিয়ামকে (পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির জন্য যে বাড়তি ব্যয়) শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে সমৃদ্ধ কার্বনমুক্ত অর্থনীতি গড়ার একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ জন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সরকারগুলোর বড় ধরনের সহযোগিতার দরকার হবে। এতে এ–সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বিনিয়োগ বাড়তি গতি পাবে। ফলে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে নতুন নতুন উদ্ভাবন সম্ভব হবে।

ব্রেকথ্রু এনার্জি নামের একটি উদ্যোগের যাত্রা শুরুর জন্য আমি সহযোগিতা করেছি। এতে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন উৎপাদনে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ‘ব্রেকথ্রু এনার্জি ফেলোস’ কর্মসূচির আওতায় এ বিষয়ে নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করতে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

ব্রেকথ্রু এনার্জি ভেঞ্চারের আওতায় পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন নিয়ে কাজ করা কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আর ব্রেকথ্রু এনার্জি ক্যাটালিস্টের আওতায় অন্যান্য পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সঙ্গে ক্লিন হাইড্রোজেনের বাজার সম্প্রসারণে কাজ করা হচ্ছে।

পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেনের বহুবিধ সম্ভাবনা ও উপকারিতা বিষয়ে সবাই যত বেশি আগ্রহী হব, জীবাশ্ম জ্বালানির সত্যিকারের বিকল্প হিসেবে একে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলো তত দ্রুত এগিয়ে আসবে। আর এর মধ্য দিয়েই আমরা জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে পারি।

ইংরেজিথেকেঅনুবাদকরেছেনহাসানইমাম