গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও শান্ত থাকতে বলেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি মন্তব্য করে ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে বৈশ্বিক দ্বন্দ্বকে আবার তাতিয়ে তোলার পর তাঁর এ আহ্বান এল।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত মঙ্গলবার বলেছেন, গ্রিনল্যান্ডকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য শুল্ক আরোপের কৌশল অথবা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে তিনি প্রস্তুত।
ট্রাম্পের মন্তব্যের জেরে গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদে বলেছেন, ‘গ্রিনল্যান্ডের মালিক গ্রিনল্যান্ডবাসী।’
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনল্যান্ড দখল করা ‘হয়ে উঠবে না’। অধিগ্রহণের বিষয়ে ট্রাম্পকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জার্মানি আর ফ্রান্সও।
এদিকে ট্রাম্পের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র গত মঙ্গলবার অঞ্চলটিতে পা রেখেছেন। তিনি ৫৭ হাজার জনসংখ্যার ‘গ্রিনল্যান্ডকে আবারও মহিমাময় করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প দ্বীপটি নিয়ে এ বিতর্কের সূচনা করেছিলেন ২০১৯ সালে। তখন তিনি বলেছিলেন, গ্রিনল্যান্ডের জন্য দর হাঁকার কথা ভাবছেন। বিষয়টিকে তিনি নিতান্তই ভূসম্পত্তি কেনাবেচা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
গ্রিনল্যান্ড ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ডেনমার্কের একটি উপনিবেশ ছিল। বর্তমানে এটি ডেনমার্কের অধীনে থাকা একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ২০০৯ সালে ভোটের মাধ্যমে দ্বীপটি স্বাধীনতা দাবি করার অধিকার অর্জন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী ডেনমার্ক অধিকৃত করলে যুক্তরাষ্ট্র গ্রিনল্যান্ড দখল করেছিল। ১৯৪৫ সালে দ্বীপটি ডেনমার্কের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
ট্রাম্প এমন এক সময়ে গ্রিনল্যান্ড অধিকার বা অধিভুক্ত করার কথা বললেন, যখন ডেনমার্কের কাছ থেকে দ্বীপটির স্বাধীনতা অর্জন নিয়ে একটি বিতর্ক চলছে। গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিউট এগেদে স্বাধীনতার পক্ষে। ২০১৯ সালে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জরিপে দেখা গেছে, গ্রিনল্যান্ডের প্রাপ্তবয়স্কদের ৬৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যতে কোনো না কোনো সময় ডেনমার্কের অধীনতা থেকে স্বাধীন হতে চান।
ট্রাম্পের দখলকামিতাকে গ্রিনল্যান্ডবাসী কী চোখে দেখছেন? গার্ডিয়ানের অনুরোধে সাড়া দিয়ে মতামত জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন।
‘আমাদের দেশ আমাদের—এটা বিক্রির জন্য নয়। ট্রাম্প অনেক কিছুই বলেন, যা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু এবারের ব্যাপারটি বেশ ভীতিকর। ন্যুক বিমানবন্দরে “ট্রাম্প”লেখা বোয়িংয়ের ৭৫৭ মডেলের একটি উড়োজাহাজ (মঙ্গলবার ট্রাম্প জুনিয়রের সফরের সময়) দেখে কী ঘটছিল, তা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। বিশ্বাস করতে পারিনি এসব কী ঘটছে। একেবারে আজব পরাবাস্তব একটা অভিজ্ঞতা।
‘আমাদের অধিভুক্ত করার কথা একই সঙ্গে ভয়ংকর ও হাস্যকর। তিনি যদি সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেন, তার অর্থ দাঁড়াবে বাদবাকি ন্যাটো সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা। আর ডেনমার্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক আরোপ করা মানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাকি সব দেশের ওপরও তা বর্তানো।
‘আমার ভয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যেমনটা করেছেন, সেই একই ধারার বিভাজন তিনি এখানেও সৃষ্টি করতে পারেন। আমরা (এখানেও) এরই মধ্যে লোকজনকে মেগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) ক্যাপ পরতে দেখছি। আমার ভয় হয়, তাঁরা অপপ্রচার শুরু করবেন এবং আমাদের নির্বাচন ও আমরা কীভাবে দেশ চালাব, সেটাকে প্রভাবিত করবেন।
‘গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়ে একটি গণভোটের সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি ব্যাপক আলাপ-আলোচনা চলছে। এর মধ্যে আমরা যদি অন্য একটি দেশের কাছে নিজেদের বিক্রি হতে দিতে রাজি হই, সেটা খুব আজব হবে।’ ওলে হোর্থ (২৭) পেশায় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। তিনি রাজধানী ন্যুকের বাসিন্দা।
এটা আমাদের কণ্ঠস্বর এবং মানুষের পরিচয় ছিনিয়ে নিচ্ছে: প্যাট্রিক আব্রাহামসেন
‘আমি গায়ের জোরে গ্রিনল্যান্ড দখলের হুমকির চরম নিন্দা জানাই।
‘আমি আধা-ইনুইট। কিছু কথাবার্তা এখন ইনুইট জাতির মানুষদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চপদধারী অনেক ব্যক্তি এখন গ্রিনল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ডের জনগণকে নিয়ে এমনভাবে কথা বলছেন, যেন এসব কোনো বস্তু, সম্পত্তি বা কেনাবেচার সামগ্রী। এটা আমাদের কণ্ঠস্বর এবং মানুষের পরিচয় ছিনিয়ে নিচ্ছে।
‘এমনটা আমরা দেখেছি গতবার, ২০১৯ সালে, যখন ট্রাম্প “ভূসম্পত্তি কেনাবেচার বড় মওকা” নিয়ে আলাপ পেড়েছিলেন।
‘আমার চার সন্তান আছে। তাদের বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা কোনোটা হবে—এই পুরো পরিস্থিতি এখন সেসব প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসছে, যা কি না যেকোনো বাবা-মায়েরই ভাবনায় থাকে।
‘সাধারণ মানুষের পাশে থাকা আমাদের এই কল্যাণ রাষ্ট্র (ওয়েলফেয়ার স্টেট) ডেনমার্কের মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা, স্কুল, শিশুপরিচর্যা এবং অন্যান্য বিষয়ে আমাদের নিজস্ব পথ খুঁজে বের করা দরকার। সেটা করতে হবে আমাদের নিজস্ব গতিতে।’ প্যাট্রিক আব্রাহামসেন (৪৫) ন্যুকবাসী। পেশায় অনুসন্ধান ও উদ্ধারকর্মী।
আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য স্বাধীনভাবে চালাতে চাই: মালিনা
‘আমরা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা গড়তে এবং ডেনমার্ক থেকে আলাদা হয়ে যেতে প্রস্তুত। না, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হতে চাই না। কিন্তু আমরা ডেনমার্কের অংশ হয়েও থাকতে চাই না।
‘আমরা অন্য সব দেশের মতো স্বাধীন হতে চাই। আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত আছি। আমাদের শত্রু নেই। আমাদের প্রথম বিমানবন্দরগুলো তৈরি করেছিল আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গ্রিনল্যান্ড ছিল আমেরিকার হাতে। দেশটি তখন গ্রিনল্যান্ডকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। তখনই প্রথমবারের মতো (গ্রিনল্যান্ডের) প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয়েছিল।
‘১৯৭৯ সালে গ্রিনল্যান্ড নিজস্ব সরকার পায় (যখন গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা হয়) এবং ২০০৯ সাল থেকে গ্রিনল্যান্ড স্বাধীনভাবে আমাদের দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। কিন্তু ডেনমার্ক রাজ্যের মধ্যে (থেকে)। আমাদের বিক্রি করে দেওয়ার আর কোনো অধিকার ডেনমার্কের নেই।’ ৩৯ বছর বয়সী মালিনা পেশায় শিক্ষক।
‘ট্রাম্পের উল্লেখযোগ্য প্রভাবের কারণে শুরুর দিকে আমি অস্বস্তি করেছিলাম। কিন্তু গ্রিনল্যান্ডের সরকার যখন দৃঢ়ভাবে বলল যে গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয় এবং কখনো তা হবে না, তখন আমি আশ্বস্ত হলাম।
‘গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যে চলমান রাজনৈতিক উত্তেজনা দুঃখজনক এবং পুরোপুরি স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটিও জোরালো। তবে এটা (রাজনৈতিক বাদানুবাদ) গ্রিনল্যান্ডবাসী হিসেবে ডেনমার্কের শাসনাধীনে ভোগ করা সুযোগ-সুবিধা এবং উন্নত জীবনমানকে দাম দিতে আমাদের উৎসাহী করেছে।
‘(স্বাধীনতার বিষয়ে) গ্রিনল্যান্ডবাসী বিভক্ত। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, পুরোপুরিভাবে স্বাধীনতা চাওয়ার আগে গ্রিনল্যান্ডকে কিছু মুখ্য বিষয়ের সুরাহা করতে হবে। বিশেষ করে আর্থিক স্থিতিশীলতা, আরও বড় ও শিক্ষিত কর্মশক্তির প্রয়োজনীয়তা—এসবের। আমি এটাকে (স্বাধীনতা) দেখি ভবিষ্যতের জন্য একটি লক্ষ্য হিসেবে, কিন্তু এটা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সুবিধাজনক কোনো ব্যাপার হবে না।
‘আমি বিশ্বাস করি, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা খোঁজার আগে গ্রিনল্যান্ডবাসী হিসেবে স্বাধীনভাবে নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদগুলো ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার সুযোগ আমাদের থাকা উচিত। আমাদের ভবিষ্যতের উন্নয়নকে সাহায্য করার জন্য এই সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকা অপরিহার্য।’ ফ্রান্স এইচ পিটারসেন (২১) শিক্ষার্থী। তিনি গ্রিনল্যান্ডের মনিতসক শহরের বাসিন্দা।