ডোনাল্ড ট্রাম্পের কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল—এমনটি প্রমাণিত হলে তিনি বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে যাবেন। গুপ্তচর আইনে দীর্ঘমেয়াদি জেলের ব্যবস্থা রয়েছে।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিন রকম অভিযোগ আনা হয়েছে—গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথির অপব্যবহার, বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধাদান এবং গুপ্তচর আইনের লঙ্ঘন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক গুপ্তচর আইনের লঙ্ঘন। এ আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বড় ধরনের শাস্তি হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের বাসভবনে তল্লাশি করে চোরাই মাল উদ্ধার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই। যেমন তেমন চোরাই মাল নয়, দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এমন ‘সর্বোচ্চ গোপনীয়’ ১১ বাক্স নথি। এর মধ্যে এমন সব নথি ছিল, যার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার। বিদেশি শত্রুর হাতে পড়লে তা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
নির্বাচনে পরাজিত হয়ে হোয়াইট হাউস ছেড়ে আসার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব নথি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী এসব নথির একমাত্র মালিক মার্কিন সরকার, যার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব জাতীয় মহাফেজখানার। তিনি কেন এসব নথি সঙ্গে এনেছেন, তিনি ছাড়া আর কে কে এই নথি দেখার সুযোগ পেয়েছে, বিদেশিদের হাতে তা পড়েছে কি না, এফবিআই এখন তা তদন্ত করে দেখছে।
প্রাথমিক তথ্যানুসারে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিন রকম অভিযোগ আনা হয়েছে—গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নথির অপব্যবহার, বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধাদান এবং গুপ্তচর আইনের লঙ্ঘন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্রাম্পের জন্য বিপজ্জনক গুপ্তচর আইনের লঙ্ঘন।
এ আইন অনুসারে নিরাপত্তাবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ, হস্তান্তর অথবা হারানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে বড় ধরনের শাস্তি হতে পারে। এ ছাড়া ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেনশিয়াল রেকর্ডস অ্যাক্টেও বিচারের সম্মুখীন হতে পারেন এই সাবেক প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্প ও তাঁর অনুগত সমর্থকেরা যুক্তি দেখিয়েছেন, যেকোনো ‘গোপনীয়’ নথি উন্মুক্ত করার অধিকার প্রেসিডেন্টের রয়েছে। অনেক সময় অবসরমতো পড়ে দেখার জন্য কোনো কোনো নথি ট্রাম্প নিজ বাসভবনে নিয়ে আসতেন। এটা আদৌ কোনো অপরাধ নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ আরও অনেকের এ অভ্যাস ছিল। সমস্যা হলো ট্রাম্প এখন আর প্রেসিডেন্ট নন। তাঁর হাতে কোনো জাদুদণ্ড নেই যে তা ঘোরালেই গোপনীয় নথি অগোপনীয় হয়ে পড়বে। তা ছাড়া ফ্লোরিডার মার-আ-লাগো তাঁর ব্যক্তিগত বাসভবন, এখানে সরকারি নথি বাক্সবন্দী করে এনে গুদামঘরে ফেলে রাখার কোনো আইনগত অধিকার তাঁর নেই। সবচেয়ে বড় কথা, পারমাণবিক ভান্ডারবিষয়ক কোনো ‘সর্বোচ্চ গোপনীয়’ নথি নির্ধারিত রক্ষণাগারের বাইরে আনার ক্ষমতা খোদ প্রেসিডেন্টেরও নেই। সাবেক প্রেসিডেন্টের তো নয়ই।
ট্রাম্প কেন, কার বুদ্ধিতে এ কাজ করলেন, তা বোঝা দুষ্কর। তবে সরকারি নথি ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর ঢিলেঢালা অভ্যাস অবশ্য এখন আর কোনো গোপন ব্যাপার নয়। তাঁর প্রশাসনের সাবেক কর্মীরাই জানিয়েছেন, কোনো নথি পড়ার পর তিনি হয় ছিঁড়ে ফেলতেন বা পকেটে রেখে দিতেন। ছেঁড়া নথি পরে জোড়া লাগানোর কথাও জানা গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস–এর সাংবাদিক ম্যাগি হ্যাবারম্যান এমন কথাও জানিয়েছেন, ট্রাম্প অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ নথি পড়া শেষে শৌচাগারে ফেলে দিতেন।
এফবিআই সাবেক প্রেসিডেন্টের বাসভবনে খানাতল্লাশি চালিয়েছে—এ কথা প্রকাশিত হওয়ামাত্র ট্রাম্পের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাম্প আগে থেকেই এফবিআইকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ করে আসছেন। তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে একাধিক সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য এ অনভিপ্রেত পদক্ষেপের জন্য এফবিআই ও বিচার বিভাগের কঠোর সমালোচনা করেছেন। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান দলীয় নেতা কেভিন ম্যাকার্থি হুমকি দিয়েছেন, তাঁরা (রিপাবলিকান) কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যারিক গারল্যান্ডের অভিশংসনের ব্যবস্থা নেবেন। অবশ্য তার জন্য অপেক্ষা না করে জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য মারজোরি টেইলার গ্রিন ইতিমধ্যে অভিশংসনের নোটিশ জারি করেছেন।
বিচারব্যবস্থা ও আইন প্রয়োগকারী বিভাগের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান নেতাদের এ ঢালাও আক্রমণের ফল হয়েছে এই যে ট্রাম্প সমর্থকদের মধ্যে সহিংস আক্রমণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। সামাজিক তথ্যমাধ্যমে খোলামেলাভাবে ‘বিদ্রোহের’ ডাক দেওয়া হচ্ছে। তিন দিন আগে, ১১ আগস্ট ওহাইও রাজ্যের সিনসিনাটিতে এক ট্রাম্প সমর্থক স্থানীয় এফবিআই অফিসে বন্দুক হামলা করে বসেন। যে বিচারক ট্রাম্পের বাড়ি খানাতল্লাশির অনুরোধ অনুমোদন করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে হামলার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এফবিআইয়ের কর্মীরা।
অনেকেই বলছেন, খানাতল্লাশির এ ঘটনাকে ব্যবহার করে ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবেন। তিনি ইতিমধ্যে নিজেকে একজন ‘রাজনৈতিক শহীদ’ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। একই যুক্তিতে তিনি নিজ সমর্থকদের কাছ থেকে দেদার চাঁদা আদায়ের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ট্রাম্প অতিগোপনীয় নিরাপত্তা তথ্য বেহাত করেছিলেন—এ কথা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা কিছুটা বেকায়দায় পড়েছেন।
বাইডেন প্রশাসন প্রথম থেকেই বলে আসছে, খানাতল্লাশির ব্যাপারে তারা কোনোভাবেই জড়িত নয়। সব সিদ্ধান্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও এফবিআইয়ের প্রধানের। রিপাবলিকান সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যারিক গারল্যান্ডকে সংবাদ সম্মেলন করে বলতে হয়েছে, এ সিদ্ধান্ত তাঁর নিজের। সব দিক বিচার-বিবেচনা ও অন্যান্য ব্যবস্থায় ফল না পাওয়ায় তাঁকে এ পথে এগোতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, ট্রাম্প ও তাঁর আইনজীবীরা দাবি করেছেন, তাঁরা বিচার বিভাগের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করে আসছিলেন। তাই হঠাৎ খানাতল্লাশির জন্য লোক পাঠানো মোটেই সংগত হয়নি। কথাটা যে সত্য নয়, তা প্রমাণের জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকেই মুখ খুলতে হয়। ১৮ মাস ধরে জাতীয় মহাফেজখানা ও বিচার বিভাগ এসব গোপনীয় নথি উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে। অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, জুন মাসে বেশ কিছু নথি উদ্ধারও করা হয়। কিন্তু অতিগোপনীয় নথি মার-আ-লাগোতে রয়ে গেছে, গোপন সূত্রে এ খবর জানার পর যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খানাতল্লাশির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
তদন্তের পর যদি দেখা যায় আসলে তেমন গোপনীয় কোনো নথি ট্রাম্পের হেফাজতে ছিল না; তাহলে শুধু বিচার বিভাগ নয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসনও বিপাকে পড়বে। ট্রাম্পের অনুগত সমর্থকেরা আগে থেকেই তেতে আছেন। তদন্ত ফাঁকা প্রমাণিত হলে তাঁদের ক্ষোভ আরও বাড়বে। এর প্রভাব আগামী নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে পড়বে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
তবে যদি ঠিক তার উল্টো হয়, যদি প্রমাণিত হয় ট্রাম্পের কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল, তাতে তিনি বড় ধরনের ঝামেলায় পড়ে যাবেন। গুপ্তচর আইনে দীর্ঘমেয়াদি জেলের ব্যবস্থা রয়েছে। নিদেনপক্ষে যা হতে পারে তা হলো আগামী কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তিনি অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন।
ট্রাম্প অবশ্য যুক্তি দেখাতে পারেন, অপরাধী হলে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যাবে না, এ কথা শাসনতন্ত্রে লেখা নেই। এ প্রশ্নে পাল্টাপাল্টি যুক্তি শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে গড়াতে পারে, সেখানে তিনি হয়তো রক্ষণশীল বিচারকদের সহানুভূতি পেতে পারেন।
চূড়ান্ত ফল যা–ই হোক, এ কথায় ভুল নেই, খানাতল্লাশি নিয়ে চলতি উত্তেজনা যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক–রিপাবলিকান (বা নীল ও লাল) এ বিভক্তি আরও বাড়াবে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, আগামী নির্বাচনের ফলাফল পছন্দমাফিক না হলে সহিংসতা দেখা দিতে পারে।
কেউ কেউ গৃহযুদ্ধ বা ‘সিভিল ওয়ার’–এর কথাও বলেছেন। ক্লিনটন প্রশাসনের সাবেক শ্রমমন্ত্রী রবার্ট রাইশ তো বলেই বসেছেন, সেই গৃহযুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ বিভক্তির কেন্দ্রে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ও অব্যাহত বর্ণবাদ। ট্রাম্পের কারণে এ বিভক্তি বেড়েছে। কিন্তু তিনি এর কারণ নন, উপসর্গ মাত্র।