হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জার

কিসিঞ্জারের আলোচিত-সমালোচিত পররাষ্ট্রনীতি

রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ড—এই দুই মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনেই কাজ করেছিলেন সদ্য প্রয়াত হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। কিসিঞ্জার তাঁর পররাষ্ট্রনীতির জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবারই আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন।  কিসিঞ্জারের এমনই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা জেনে নেওয়া যাক।

চীন
১৯৭১ সালের জুলাইয়ে গোপনে বেইজিংয়ে চলে গিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। এর মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে চীনে নিক্সনের যুগান্তকারী সফরের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। ওই সফরে নিক্সন স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি তুলেছিলেন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য চীনের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছিলেন।

ওই সময় অনেকটাই একঘরে বলে বিবেচিত চীনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়ায় উৎপাদন খাতে বেইজিংয়ের উত্থান ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এটি বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জার। ১৭ মার্চ ২০১৫, বেইজিং-এর গ্রেট হলে

কিসিঞ্জার যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ছাড়েন, তত দিনে তিনি চীনের পরামর্শকের খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। দায়িত্ব ছাড়ার সময় কিসিঞ্জার সতর্ক করে বলেছিলেন, মার্কিন নীতিমালায় বড় ধরনের পালাবদল ঘটতে পারে।

১০০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার কয়েক মাস পর গত জুলাইয়েও কিসিঞ্জার চীন সফর করেছেন। সেখানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং অন্য চীনা নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন।

ভিয়েতনাম
নিক্সন যখন ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধের সমাপ্তি টানার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তখনই গোপনে কম্বোডিয়া ও লাওসে বোমা হামলা চালানোর নির্দেশ দেন কিসিঞ্জার। ভিয়েতনামের সরবরাহ লাইনগুলো বন্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। কয়েকজন ইতিহাসবিদের হিসাব অনুসারে, ওই হামলায় কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হন।

১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে প্যারিসে আলোচনার মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতিতে সক্ষম হন কিসিঞ্জার। এর জন্য ওই বছর ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা লি ডাক থো এবং হেনরি কিসিঞ্জারকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে লি ডাক থো সে পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে প্যারিস চুক্তির মধ্য দিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির মাত্রা কমানো যায়নি। এমন অবস্থায় সাইগনে (হো চি মিন সিটি) যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত সরকারের পতন হওয়ার দুই বছরের বেশি সময় পর কিসিঞ্জার বিরতি চেয়েছিলেন বলে মনে করা হয়ে থাকে।

অভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্টতা
হেনরি কিসিঞ্জার বিভিন্ন দেশে বামপন্থী সরকার উৎখাতে প্ররোচনা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও চিলিতে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন।

হেনরি কিসিঞ্জারের ঠান্ডা মাথায় করা একটি হিসাব–নিকাশের মেমোতে দেখা গেছে, কিসিঞ্জার বলেছিলেন, চিলির সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সালভাদর আইয়েন্দে ‘প্রতারণাপূর্ণ’ একটি মডেল প্রস্তাব করেছেন। ওই মডেলে দেখানো হয়েছে, বামপন্থী নির্বাচিত সরকার কাজ করছে।

সিআইএ–সমর্থিত এক সেনা অভ্যুত্থানে আইয়েন্দে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর আইয়েন্দে আত্মহত্যা করেন।

ইসরায়েলের তেল আবিবে হেনরি কিসিঞ্জার, ১৯৭৪ সালের ২৫ মার্চ

হামলায় সায়
একটি দেশ যখন অন্য কোনো দেশে হামলা চালাত, তখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকলে কিসিঞ্জার সে হামলার বিরোধিতা করতেন না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে তেমনটাই দেখা গেছে। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চালানো হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনার পরও পশ্চিম পাকিস্তানকে কিসিঞ্জার কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছেন।

স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ইন্দোনেশিয়া যখন পূর্ব তিমুর দখল করে নিয়েছিল, ২৪ বছরের নৃশংস দখলদারি শুরু করেছিল, তখন কিসিঞ্জার তাতে সবুজসংকেত দিয়েছিলেন।

সাইপ্রাসের এক-তৃতীয়াংশ দখলে তুরস্ককেও কিসিঞ্জার মৌন সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে কৌশলগত অবস্থানে থাকা তুরস্কের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি ন্যাটোর সদস্যদেশ গ্রিসের সঙ্গে শত্রুতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন তিনি।

অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন যে সম্পৃক্ততা ছিল, তাতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন কিসিঞ্জার। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের কিউবান মিত্রদের মোকাবিলায় ওই গৃহযুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

মধ্যপ্রাচ্য
কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনে দায়িত্বপালনকালে বেশির ভাগ সময় মধ্যপ্রাচ্যের দিকে নজর দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ইহুদিদের ইয়ম কিপুর পালিত হওয়ার দিনে আরব রাষ্ট্রগুলোর হামলার পর মিত্রদেশ ইসরায়েলকে অস্ত্র দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর উদ্যোক্তা ছিলেন কিসিঞ্জার।

কিসিঞ্জার পরবর্তী সময়ে ইসরায়েল, মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘মধ্যস্থতার কূটনীতি’।

এ ক্ষেত্রে মস্কোর ভূমিকাকে কার্যকরভাবে উপেক্ষা করে কিসিঞ্জার মিসরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আরব দেশ মিসর পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগী হয়ে ওঠে। মিসরকে সহায়তা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।