পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিন রাজ্যের ভোট ঠিক করে দেবে, কে হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট।
যুক্তরাষ্ট্রে ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে ভোট গণনা। একজন নতুন প্রেসিডেন্ট ছাড়াও একটি নতুন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচিত করবেন মার্কিন ভোটাররা। সবাই একমত, সিনেটে রিপাবলিকান দল নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছে। প্রতিনিধি পরিষদেও রিপাবলিকানদের অবস্থা ভালো। হিসাবে বড় ধরনের গোলমাল না হলে তারাই কংগ্রেসের উভয় কক্ষে নিয়ন্ত্রণ পেতে পারে।
কিন্তু হোয়াইট হাউসের কী হবে? কে হবেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট? ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস? সেই প্রশ্নের জবাব দিতে গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া শুরু করেন মার্কিন ভোটাররা। নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর ডক্সিভিল নচে গত সোমবার মধ্যরাতে ছয়জন ভোট দেন। সেখানে ট্রাম্প ও কমলা তিনটি করে ভোট পেয়েছেন।
পরে গতকাল স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটায় ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যে প্রথম ভোটকেন্দ্র খোলা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ইতিমধ্যে ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ ভোট দেওয়ার ফলে কেন্দ্রগুলোতে তুলনামূলক ভিড় কম দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আলাপ-আলোচনায় যা বোঝা যাচ্ছে, তা ট্রাম্পের অনুকূলে। ফলে উদ্বেগ বাড়ছে। কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রিপাবলিকান দল ও হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু আমেরিকার জন্য নয়, বিশ্বের জন্যই একটি দুঃসংবাদ। সঙ্গে অনুগত সুপ্রিম কোর্ট থাকায় তাঁর যা খুশি, তা করায় কোনো বাধাই থাকবে না।
এ কথা বারবার বলা হয়েছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নির্ভর করছে সাতটি দোদুল্যমান বা অনিশ্চিত অঙ্গরাজ্যের ওপর। আসলে সাতটি নয়, মাত্র তিনটি রাজ্যের ভোট মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা ঠিক করে দেবে। এই তিনটি রাজ্য হলো পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিন। এই তিনটি রাজ্যে জয়ী হলেই কমলা তাঁর প্রয়োজনীয় ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে যাবেন। এটি তাঁর জন্য সবচেয়ে সহজ পথ।
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পেনসিলভানিয়া ছাড়া জর্জিয়া ও নর্থ ক্যারোলাইনা জিতে নেন, তাহলেই তাঁর মোক্ষ লাভ হবে। দুজনের জন্যই একাধিক বিকল্প পথ রয়েছে, কিন্তু এটিই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত।
কেন পেনসিলভানিয়া
১৯টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের কারণে পেনসিলভানিয়া দোদুল্যমান রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে কথা মাথায় রেখে কমলা ও ট্রাম্প নির্বাচনের আগের দিনও এখানে ঘুরে গেছেন। উদ্দেশ্য, সামান্য কিছু ভোটার এখনো যে মনস্থির করতে পারেননি, তাঁদের মন জয়। রাজ্যটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারিয়েছে। একসময়ের রমরমা কয়লা ও লোহার খনিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। উৎপাদন খাতেও মন্দা এসেছে। ফলে অর্থনৈতিক সাফল্যের কোনো গীত গাওয়া কমলার পক্ষে সম্ভব নয়।
এই রাজ্যের ভোটারদের এক বড় অংশ গ্রামীণ, যাঁরা প্রথাগতভাবে রক্ষণশীল, রিপাবলিকান দলের প্রতি আকৃষ্ট। বড় বড় শহরের বাইরে, যেখানে শ্বেতকায় ও কম শিক্ষিত মানুষের আধিক্য এবং যাঁরা ট্রাম্পের অভিবাসনবিরোধী কথাবার্তায় খুশি, তাঁরা কমলার প্রতি আস্থা আনতে পারছেন না। আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিকদের একটি অংশ ট্রাম্পের সঙ্গে একমত, সব বহিরাগতকে খেদাতে হবে।
গর্ভপাতের প্রশ্নে কমলা নারীদের ভোট পাবেন এ কথা ঠিক, শহুরে শিক্ষিত নারী-পুরুষের বড় অংশের ভোটও তিনি পাবেন। কিন্তু তাতে ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যবধান কমানো সম্ভব কি না, তা অনিশ্চিত।
শেষ সময়ে ট্রাম্পের হোঁচট
অর্থনীতি ও অভিবাসন—এই দুই প্রশ্নে সুবিধাজনক অবস্থা থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রচারের শেষ সময়ে এসে কিছু ভুল করেছেন, যা কিছুটা হলেও কমলার সুবিধা করে দেবে। এই অঙ্গরাজ্যে বড় সংখ্যায় পুয়ের্তো রিকো থেকে আসা মানুষের বাস। দিন দশেক আগে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ট্রাম্পের জনসভায় পুয়ের্তো রিকোকে ভাসমান জঞ্জাল বলায় তিনি হয়তো এই রাজ্যের প্রায় চার লাখ পুয়ের্তো রিকানের একাংশকে হারাবেন। যে ভাষায় তিনি কমলা ও অন্য নারী রাজনীতিকদের আক্রমণ করেছেন, তাতে নারী ভোটারদের একাংশ ক্রুদ্ধ হতে পারে।
কমলা ও ট্রাম্পের প্রচারের সমাপ্তি বক্তব্য নাটকীয়ভাবে ভিন্ন। কমলা এক সুখী, সম্ভাবনাময় ও ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার ছবিটি তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প আমেরিকাকে বিশ্বের ‘ডাস্টবিন’ বলে চিহ্নিত করে হতাশাজনক চিত্র এঁকেছেন। লাখ লাখ বহিরাগত ধেয়ে আসছে দেশটি দখল করতে। এই অবস্থা বদলানোর একটাই পথ, তাঁকে নির্বাচিত করা।
এই দুই চিত্রের কোনটির প্রতি সমর্থন জানাবেন মার্কিন ভোটাররা?
আমেরিকার বিখ্যাত জনমত জরিপ বিশেষজ্ঞ নেইট সিলভার মনে করেন, এই নির্বাচনে কমলার জয়ের সম্ভাবনা নেই। ২০১৬ সালে ৩০ লাখ ভোট পেয়েও হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের কাছে হেরেছেন। সিলভারের নির্বাচনী মডেল অনুসারে, এবারও কমলা মোট ভোটের হিসাবে এগিয়ে থাকবেন, কিন্তু ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে হিলারির মতো হেরে যাবেন।
সিলভারের মডেল অনুসারে, কমলা মিশিগান ও উইসকনসিনে জিতবেন, কিন্তু পেনসিলভানিয়ায় হেরে যাবেন। অন্যদিকে ট্রাম্প পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা ও নর্থ ক্যারোলাইনায় জিতে প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেয়ে যাবেন।
নেইট সিলভার বলেছেন বলেই এটাই চূড়ান্ত ফলাফল, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। ২০১৬ সালে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন হিলারির জেতার সম্ভাবনা ৭১ শতাংশ। বাস্তবে কী হয়েছিল, তা আমরা সবাই জানি।
আইওয়ার জনমত জরিপ
একটি বিকল্প চিত্রও রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৮ কোটি ২০ লাখ মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন, যার একটা বড় অংশই নারী। আমরা জানি, ট্রাম্পের তুলনায় নারীদের ভোট বেশি পাবেন কমলা। কোনো কোনো জরিপ থেকে এমন আভাসও আসছে, যাঁরা এত দিন কাকে ভোট দেবেন ঠিক করেনি, তাঁরাও অধিক সংখ্যায় কমলার দিকে ঝুঁকছেন।
এ রকম একটি জরিপ এসেছে আইওয়া থেকে। সেখানকার দায়িত্বশীল পত্রিকা ডে ময়েন রেজিস্টার দুই দিন আগে যে জরিপ প্রকাশ করেছে, তাতে ট্রাম্পের চেয়ে কমলা ৪ পয়েন্টে এগিয়ে (৪৭/৪৩)। এটি বিস্ময়কর; কারণ, আইওয়া রিপাবলিকান প্রভাবিত অঙ্গরাজ্য। সেখানে পরপর দুবার ২০১৬ ও ২০২০ সালে ট্রাম্প বড় ব্যবধানে জিতেছেন। জনসংখ্যার অনুপাতে এই রাজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ শ্বেতকায়, খ্রিষ্টপন্থী ও রক্ষণশীল। তাঁরা কেন কমলার দিকে ঝুঁকবেন?
এই জরিপ অনুসারে আইওয়ার নারী ভোটারদের ৫৬ শতাংশ কমলা ও ৩৬ শতাংশ ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। আবার ৬৫-এর বেশি বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে কমলা ও ট্রাম্পের সমর্থনের হার যথাক্রমে ৫৫ ও ৩৬ শতাংশ।
এর মানে কী? ভাবা হচ্ছে, নির্বাচনী প্রচারের শেষ সময়ে এসে মধ্য-পশ্চিমের অতি-নম্র, অতি-বিনয়ী হিসেবে পরিচিত এই রাজ্যের নারী-পুরুষ ট্রাম্পের কথায় ও ব্যবহারে বিরক্ত। নেইট কোহনের মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শেষ সময়ে ভোটাররা, বিশেষত নারীরা কমলার দিকে ঝুঁকছেন।
আইওয়ার মতো আর কোনো রিপাবলিকান-প্রভাবিত বা দোদুল্যমান রাজ্যে শেষ সময়ে ভোটারদের মনোভাব একই রকম পরিবর্তন এসেছে কি না, এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো আজ পাওয়া যেতে পারে।
পাদটীকায় ইতিহাসবিদ এলেন লিখটম্যানের কথা স্মরণ করা যায়। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক গত ১০টি নির্বাচনের ৯টি সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ১৩টি প্রশ্নের ভিত্তিতে তৈরি একটি মডেল ব্যবহার করে অধ্যাপক লিখটম্যান পূর্বাভাস করে থাকেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মডেল অনুসারে ট্রাম্প নয়, কমলাই যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।