রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে রাশিয়ার গুচ্ছ ও ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ সম্পর্কে হোয়াইট হাউসের তৎকালীন প্রেস সেক্রেটারি বলেছিলেন, অভিযোগ সত্য হয়ে থাকলে এটি সম্ভাব্য ‘যুদ্ধাপরাধ’। এখন যুক্তরাষ্ট্রই ইউক্রেনকে গুচ্ছবোমা দিচ্ছে। শুধু মানবাধিকার সংগঠনগুলোই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে না, অস্বস্তিতে পড়েছে ওয়াশিংটনের মিত্ররাও। এ পটভূমিতে গুচ্ছবোমা নিয়ে বাইডেনের অবস্থান নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন ওয়াশিংটন পোস্টের জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিবেদক অ্যারন ব্লেক।
১৬ মাসের ব্যবধান। ২০২২ সালের মার্চে জাতিসংঘের অধিবেশনে মার্কিন দূত যা বলেছিলেন, সেই অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরে এলেন চলতি সপ্তাহে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আয়োজিত ওই অধিবেশনে ক্লাস্টার বা গুচ্ছবোমা নিয়ে বাইডেনের পক্ষে তাঁর দূত লিন্ডা গ্রিনফিল্ড–টমাস নেতিবাচক মনোভাবই প্রকাশ করেছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত শুক্রবার জানান, রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে গুচ্ছবোমা দেওয়া হবে।
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘আমরা ভিডিওতে দেখেছি, রুশ বাহিনী অত্যন্ত প্রাণঘাতী সব সরঞ্জাম নিয়ে এগোচ্ছে, অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে এসবের কোনো স্থান নেই।’ তিনি আরও বলেন, ওই সব যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে জেনেভা সনদের অধীন নিষিদ্ধ গুচ্ছবোমা ও ভ্যাকুয়াম বোমা।
তবে এর দুই দিনের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থান বদলেছে; আনুষ্ঠানিক বিবৃতির ‘যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো স্থান নেই’—এই অংশের ‘সংশোধনী’ দেয় তারা। জেনেভা সনদের নিষিদ্ধকরণের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে একটি তারকাচিহ্ন বা অ্যাস্টেরিক যুক্ত করে মার্কিন বিবৃতিতে বলা হয়—‘এটা কেবল বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার নিষিদ্ধ’।
প্রাথমিক বক্তব্য থেকে টমাস–গ্রিনফিল্ডের সরে আসার বিষয়টি অবশ্য অভূতপূর্ব বা নজিরবিহীন নয়। এখন বাইডেনও ইউক্রেনকে শক্তিশালী এই সমরাস্ত্র (গুচ্ছবোমা) দিতে প্রস্তুত বলে জানালেন।
গুচ্ছবোমাসংক্রান্ত সনদের (কনভেনশন অন ক্লাস্টার মিউনিশনস) অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মিত্রদেশই এ থেকে দূরে থাকার অঙ্গীকার করেছে। (অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন এই সনদের পক্ষ নয়, অথবা পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর এক–চতুর্থাংশও নয়।) তাদের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো সংঘাতের পর এই সমরাস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যেতে পারে, যা তাদের মিত্র সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।
ওয়াশিংটন পোস্ট এক প্রতিবেদনে বলেছে, গুচ্ছবোমা নিষিদ্ধসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আইনকে পাশ কাটিয়ে যাবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাব্য হার ১ শতাংশের বেশি নয়।
গুচ্ছবোমার ব্যবহার নিয়ে বাইডেনের অবস্থান পরিবর্তনের সর্বশেষ উদাহরণ এটা। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা সাবেক সিনেটর বাইডেন গুচ্ছবোমা প্রশ্নে রীতিমতো কুস্তি লড়েছেন এবং তিনি তাঁর ডেমোক্র্যাট সহকর্মীদের তুলনায় গুচ্ছবোমার ব্যবহারে বরাবরই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জো বাইডেন। এর আগে কিছুসংখ্যক ডেমোক্র্যাট সিনেটর গুচ্ছবোমা ব্যবহারে লাগাম টানার বিষয়ে তৎপর হয়েছিলেন। তাঁরা তখন চেয়েছিলেন, এক দেশ থেকে আরেক দেশে এই যুদ্ধাস্ত্র পাঠানোর বিষয়টি সীমিত করা হোক এবং জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এর ব্যবহার বন্ধ করা হোক।
বাইডেন প্রাথমিকভাবে ওই দাবির পক্ষে কণ্ঠ তোলেন বটে, তবে এমন পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে তার সম্ভাব্য কিছু প্রভাব নিয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি ‘সামরিকভাবে গুচ্ছবোমার চমৎকার ব্যবহারের’ কথাও তুলে ধরেন। পরে এ নিয়ে শুনানির আয়োজন করেন তিনি।
২০০৬ সালে বাইডেন বলেছিলেন, এটাকে আইনসিদ্ধ বিবেচনা করা যায় এবং সম্ভবত এটাকে আইনসিদ্ধ করাও যায়। তবে এ–সংক্রান্ত শুনানির পর এবং যথাপোযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে এর ব্যবহার হতে হবে সতকর্তার সঙ্গে।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তোলা আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে দুই ডেমোক্র্যাট সিনেটর জনবসতিপূর্ণ এলাকায় গুচ্ছবোমার ব্যবহার নিষিদ্ধে একটি সংশোধনীর প্রস্তাব করেন। ওই সংশোধনীর বিরোধিতা করেন যে ১৫ ডেমোক্র্যাট নেতা, তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাইডেন এবং তৎকালীন নিউইয়র্কের সিনেটর হিলারি ক্লিনটন। উল্লেখ্য, ইলিনয়ের সেই সময়কার সিনেটর বারাক ওবামা সংশোধনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সেই সময় লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলের গুচ্ছবোমা ব্যবহারের বিষয়টি পুনর্জীবন পায়। ইসরায়েলের হাতে থাকা সেই সব গুচ্ছবোমা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি।
একই ধরনের দৃশ্য দেখা যায় গত শতকের আশির দশকের গোড়ায়। সেই সময় সিনেটর বাইডেন ও অন্যরা গুচ্ছবোমা নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন তুলে বাহাসে জড়ান। তখন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, লেবাননে আগ্রাসন চালাতে ইসরায়েল গুচ্ছবোমা ব্যবহার করেছে। এর জেরে কিছু ডেমোক্র্যাট নেতা ইসরায়েলকে দেওয়া সহায়তায় কাটছাঁট করতেও সরকারকে চাপ দেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউপিআইয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, বাইডেন তখন বলেছিলেন, যদি ওই সময়ের প্রতিবেদনগুলো সঠিক হয়, তাহলে ইসরায়েল পরিষ্কারভাবে আইন অমান্য করেছে। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ‘ভবিষ্যতে এই ধরনের অস্ত্র পাওয়ার ক্ষেত্র সীমিত করার’ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানো। তবে তিনি একই সঙ্গে ‘চূড়ান্ত বিচার’ না করার বিষয়েও সতর্কতা উচ্চারণ করেছিলেন এবং এ বিষয়ে আবারও শুনানির ডাক দিয়েছিলেন।
১৯৮২ সালের জুনে ক্যাপিটল হিলে গিয়েছিলেন ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাখিম বেগিন। তখন ডেমোক্র্যাটরা গুচ্ছবোমা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস ক্যাপিটল হিলে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের কথোপকথনকে ‘চরম আবেগপূর্ণ কথার যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। ম্যাসাচুসেটসের তৎকালীন ডেমোক্র্যাট সিনেটর পল সনগাস বলেছিলেন, ‘কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে এমন কলহপূর্ণ বা উত্তেজিত অধিবেশন’ তিনি কখনো দেখেননি।
সেই সময় বাইডেন ও বেগিনের মধ্যে যা হয়েছিল, তাকে ‘তিক্ততম মতবিনিময়’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। তবে তখন এমন কথা শোনা যায়, বাইডেন নাকি সামরিক যুদ্ধকৌশল নিয়ে আপত্তি জানাননি, বরং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনে ইসরায়েলের নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। বেগিন যখন জেরুজালেমে ফিরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, বাইডেন আরও বিস্তৃত পরিসরে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেগিন অবশ্য তখন বাইডেনের নাম উচ্চারণ করেননি, শুধু বলেছিলেন একজন ‘তরুণ সিনেটর’। তবে নিউইয়র্ক টাইমস ও টাইম ম্যাগাজিন ওই তরুণ সিনেটর হিসেবে বাইডেনকে শনাক্ত করেছিল।
বাইডেনের মিত্ররা অবশ্য বেগিনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে বিতর্কে জড়ান, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূমিতে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন ইস্যুতে মার্কিন সহায়তা স্থগিত করার হুমকির বিষয়ে।
কিন্তু ৪১ বছর পর বাইডেন আবার এক মিত্রদেশের গুচ্ছবোমা ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তের ফল হতে পারে সুদূরপ্রসারী, তবে এখন তা (গুচ্ছবোমা) দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আছে এবং তিনি তাঁর পছন্দই বেছে নিলেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ হাসান ইমাম