রয়টার্সের বিশ্লেষণ

টাইটানের নিহত যাত্রীদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাবমেরিন সরবরাহকারী কোম্পানি ওশানগেট নিখোঁজ সাবমেরিন ‘টাইটান’ পরিচালনা করে
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

আটলান্টিকের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া সাবমেরিন টাইটানের যাত্রীরা অভিযাত্রা শুরুর আগে যেকোনো বিপর্যয়ে সম্ভাব্য ‘মৃত্যুর দায় মওকুফে’ স্বাক্ষর করেছিলেন, এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।

তবে এরপরও ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের পরিবার চাইলে মামলা করতে পারে। যাত্রীদের ওই মৃত্যুর দায় মওকুফের স্বাক্ষর সাবমেরিনের মালিককে সম্ভাব্য মামলা থেকে রক্ষা করতে পারবে না বলে মনে করেন আইনবিশেষজ্ঞরা।

মার্কিন কোস্টগার্ড বলেছে, গত রোববার টাইটান নামের একটি সাবমেরিনে চড়ে আটলান্টিকের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে দেখতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন চার পর্যটকসহ পাঁচজন। চার দিন মহাসাগরের তলদেশে ব্যাপক তল্লাশির পর গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধারকারীরা সাবমেরিনটির ধ্বংসাবশেষের কিছু টুকরা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। সাবমেরিনে আকস্মিক বিস্ফোরণে একই সঙ্গে পাঁচ আরোহীর মৃত্যুর কথাও জানানো হয়েছে।

টাইটান সাবেমেরিনে পাঁচ যাত্রীর মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের একটি ধনী পরিবারের সদস্য শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তাঁর ছেলে সুলেমান দাউদ (১৯), ব্রিটিশ অভিযাত্রী হ্যামিশ হার্ডিং (৫৮), ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি পল অঁরি নাজোলে (৭৭) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাবমেরিন সরবরাহকারী কোম্পানি ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টকটন রাশ (৬১)। তিনি সাবমেরিন টাইটান চালাচ্ছিলেন।

টাইটান সাবমেরিনে চড়ে উত্তর আটলান্টিকের তলদেশে ১২ হাজার ৫০০ ফুট গভীরে টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে প্রতি যাত্রী ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার ফি পরিশোধ করেছেন। তাঁরা সবাই কোনো বিপর্যয়ে সম্ভাব্য মৃত্যুর দায় মওকুফে স্বাক্ষর করেছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএসের এক প্রতিবেদক ২০২২ সালের জুলাইয়ে সাবমেরিন সরবরাহকারী কোম্পানি ওশানগেটের সঙ্গে এ ধরনের একটি ভ্রমণে ছিলেন। তিনি বলেছেন, ভ্রমণের আগে তাঁকে সম্ভাব্য মৃত্যুর দায় মওকুফে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। তাঁর ভ্রমণ নিদের্শনার শুধু প্রথম পৃষ্ঠাতেই তিনবার মৃত্যুর আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল।

তাৎক্ষণিকভাবে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ওশানগেটের এমন মৃত্যুর দায় মওকুফের শর্তাবলির বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে মন্তব্য জানাতে গতকাল বৃহস্পতিবার অনুরোধ জানানো হলেও ওশানগেটের কেউ সাড়া দেননি।

দায় মওকুফের বিষয়গুলো সব সময় আমলে নেওয়া হয় না। কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গুরুতর অবহেলা বা বিপদের প্রমাণ পাওয়া গেলে ওই দায় মওকুফে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সম্মতি জানালেও মামলায় বিচারক তা প্রত্যাখ্যান করে রায় দিতে পারেন। যদিও টাইটানের ক্ষেত্রে এসব বিষয় এখনো পুরোপুরি প্রকাশ পায়নি।

টেক্সাসভিত্তিক অ্যাটর্নি ও সমুদ্র আইনবিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ ডি. শেফার বলেছেন, ‘যদি এই সাবমেরিনের নকশা বা নির্মাণের কিছু দিক থাকে, যা যাত্রীদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল বা এটি সাগরে তলদেশে যাওয়ার মতো উপযুক্ত নয়, এমন জটিলতা থাকা সত্ত্বেও পরিচালনা করা হয়ে থাকে, তাহলে আদালতের রায় পুরোপুরি ওই মৃত্যুর দায় মওকুফের বৈধতার বিরুদ্ধে যাবে।’

তবে ওশানগেট যুক্তি দিতে পারে, এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবহেলা ছিল না। আর দায় মওকুফের শর্তও তাদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ, ছোট ভ্যানের আকৃতির এই সাবমেরিন সমুদ্রের গভীরতম এলাকায় গেলে কী ধরনের বিপদ হতে পারে, যাত্রীদের আগেই সেসবের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

কোনো সম্ভাব্য অবহেলার মাত্রা এবং তা কীভাবে দায় মওকুফের বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নির্ভর করে বিপর্যয়ের কারণের ওপর। এ ঘটনায় এখনো তদন্ত চলছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার আইনজীবী জোসেফ লো বলেন, ‘দায় মওকুফের পরও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কী কী দাবি করতে পারে, তার অনেক উদাহরণ আছে। তবে বিপর্যয়ের কারণ না জানা পর্যন্ত দায় মওকুফ প্রযোজ্য হবে কি না, তা ঠিক করা যাবে না।’

গতকাল বৃহস্পতিবার টাইটান সাবমেরিনের ক্ষতিগ্রস্ত যাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে এটা ধারণা করা যায়, কোনো পরিবারই হয়তো এ বিষয়ে মামলার দিকে এগোবে না।

ওশানগেট ওয়াশিংটনের এভারেট কাউন্টিভিত্তিক একটি ছোট কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মতো সম্পদ আছে কি না, তা এখনো জানা যায়নি। তবে যদি প্রতিষ্ঠানটির বিমা করা থাকে, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সেখান থেকে ক্ষতিপূরণ নিতে পারে।

অবহেলার কারণেই বিস্ফোরণ ঘটেছে—যদি এমন প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে টাইটান সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনা, নির্মাণ বা উপাদান তৈরিতে সহায়তাকারী তৃতীয় পক্ষের কাছেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে।

সমুদ্র আইনে যা আছে

ওশানগেট সমুদ্র আইনে দায়বদ্ধতার তথাকথিত সীমাবদ্ধতাকে সামনে এনে এ ধরনের ক্ষতি থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করতে পারে। সাবমেরিনের মালিক পক্ষ ফেডারেল আদালতকে সাবমেরিনের বর্তমান মূল্যের ক্ষতি বিবেচনায় নিতে বলতে পারেন। যেহেতু টাইটান ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে রায় হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে ওশানগেটকে প্রমাণ করতে হবে, সাবমেরিনে কোনো সম্ভাব্য ত্রুটি ছিল না। তবে আইনবিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটি প্রমাণ করা অনেক কঠিন ব্যাপার। ওশানগেট এসব প্রমাণে ব্যর্থ হলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অবহেলা ও অন্যায়ভাবে মৃত্যুর মামলা করতে কোনো বাধা থাকবে না।

‘দ্য ডেথ অন দ্য হাই সিস অ্যাক্ট’ নামে আরেকটি সমুদ্র আইনে নৌ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল পরিবারকে শুধু সেই ব্যক্তির ভবিষ্যৎ উপার্জনের একটি অংশ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা আছে।

মামলার তদন্তের সময় মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে—ওশানগেট সাবমেরিনের নিরাপত্তা সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ নিজেরা কী জানত এবং এ সম্পর্কে যাত্রীদের কি জানানো হয়েছিল?

২০১৮ সালে ওশানগেটের নিরাপত্তা ত্রুটির অভিযোগ এনে ওয়াশিংটন ফেডারেল আদালতে একটি মামলা হয়েছিল। ওই মামলায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কর্মী ডেভিড লোচরিজ বলেছিলেন, তিনি নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুতর উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন, কিন্তু তা উপেক্ষা করা হয়েছিল।

বর্তমান বিষয় নিয়ে মামলা হলে বাদী পক্ষ এই অভিযোগ উদ্ধৃত করতে পারেন। যদিও আদালতের তথ্য বলছে, সে সময় অপ্রকাশিত শর্ত দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।

এ ছাড়া একই বছর সাবমেরিনের নিরাপত্তার বিষয়ে আমেরিকান ব্যুরো অব শিপিংয়ের সনদ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওশানগেট কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি লিখেছিলেন একটি শিল্পগোষ্ঠীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।