বিশ্বজুড়ে হঠাৎ সাড়া ফেলেছে ‘বেলুন–কাণ্ড’। শুরুটা যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে ভাসতে থাকা বিশাল আকারের একটি চীনা বেলুন দিয়ে। আকাশসীমায় অনুপ্রবেশের অভিযোগে বেলুনটি ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। এর কয়েক দিন পরে ছোট আকারের আরও তিনটি বেলুন ধ্বংস করে বাহিনীটি। এরপর আকাশে উড়তে থাকা সব জিনিস নিয়েই বাড়তি সচেতনতা দেখাচ্ছেন মার্কিনরা। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই বেলুনগুলোকে কীভাবে দেখছেন, তা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
বিনোদনের উদ্দেশ্যে ওড়ানো একটি বেলুন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ছোট যে তিনটি বেলুন ধ্বংস করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ওই বেলুনও ছিল।
বেলুন ধ্বংসের ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, দেশটির আকাশে অজ্ঞাত বস্তুগুলো নজরদারির জন্য নীতিমালা হালনাগাদ করা হচ্ছে। তিনি এটাও বলেন, প্রথম বেলুনটি গোয়েন্দাগিরির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে সন্দেহ থাকলেও পরের তিনটি বেলুন তেমন কিছু ছিল না বলেই মনে করা হচ্ছে। যার অর্থ দাঁড়ায়, পরের বেলুনগুলো গবেষণা, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, বিনোদন অথবা বাণিজ্যিক কাজে আকাশে ওড়ানো হয়েছিল।
এদিকে তুলনামূলক ছোট তিনটি বেলুনের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী। শুক্রবার রাতে ওই উদ্ধার অভিযান বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ১০ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ওই বেলুন তিনটি ধ্বংস করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যে এবং লেক হুরনের আকাশে ভাসতে থাকার সময়।
যাহোক, বেলুন–কাণ্ডে সাধারণ মানুষের সামনে দুটি বাস্তবতা উঠে এসেছে। প্রথমটি হলো, বাইডেন প্রশাসনের দাবি অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর সহায়তায় আকাশ থেকে নজরদারির একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। এ প্রকল্পের লক্ষ্য ৪০টির বেশি দেশ।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দাবি নাকচ করেছে বেইজিং। দ্বিতীয়টি হলো, সম্প্রতি যে বেলুনগুলো ধ্বংস করা হয়েছে, এমন অনেক বস্তুই আকাশে ভাসছে, যেগুলো সম্পর্কে এখনো জানা যায়নি।
ছোট আকৃতির তিনটি বেলুন ধ্বংস করতে সাইডউইন্ডার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন জো বাইডেন। এ নিয়ে রিপাবলিকান দলের সদস্যদের অভিযোগ, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাত নিশপিশ করছিল।
বেলুনগুলো দিয়ে কী করা হচ্ছে
বিগত কয়েক দিনে যে বেলুনগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং যেগুলো এখনো নজরে আসেনি, সেগুলোর একটা অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি ও যুদ্ধের কাজে। এটা কিন্তু নতুন কোনো কৌশল নয়। অষ্টাদশ শতকের আশির দশকেই বেলুনে বোমা ঝুলিয়ে, তা শত্রুপক্ষের ওপর হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। সে সময় ইতালির ভেনিস শহরে হামলা চালাতে শহরটির ওপর দিয়ে বোমাবাহী বেলুন উড়িয়েছিল অস্ট্রিয়া। এ ছাড়া যুক্তরাস্ট্রে গৃহযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের অবস্থান শনাক্ত করতে বেলুনে করে সৈন্যদের বেশ অনেকটা উচ্চতায় পাঠানো হতো।
এ ছাড়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য বেলুন ব্যবহার করা হয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য প্রতিদিন দুবার করে বিশ্বের প্রায় ৯০০ স্থান থেকে বেলুন ওড়ানো হয়। এর মধ্যে ১০০টি স্থান শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে। বিজ্ঞানীরাও গবেষণার কাজে বেলুন ব্যবহার করেন। মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একেবারে শেষ প্রান্তে বেলুন পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও গবেষণার জন্য বেলুন ওড়ায়। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অংশ হিসেবে বেলুন ওড়ানো হয়। বন্যপ্রাণীর ওপর নজর রাখতেও কাজে লাগানো হয় বেলুন।
বাণিজ্যিক খাতেও বেলুনের ব্যবহার রয়েছে। বলা চলে, প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগলের কথাই। বিশাল আকৃতির বেলুনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করতে চাইছে তারা। এরপর আসে বিনোদনের জন্য ওড়ানো বেলুনগুলোর কথা। এই বেলুনগুলো ৪০ হাজার ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উঠতে পারে। ছোট আকৃতির যে তিনটি বেলুন যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস করেছে, সেগুলো অনেকটা এই উচ্চতায় ভাসছিল বলে জানিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
এদিকে সংবাদমাধ্যম এভিয়েশন উইক নেটওয়ার্কের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনোদনের উদ্দেশ্যে ওড়ানো একটি বেলুন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ছোট যে তিনটি বেলুন ধ্বংস করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ওই বেলুনটিও ছিল। তবে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি শুক্রবার বলেন, এই প্রতিবেদন আদৌ সত্য কি না, তা যাচাই করে দেখা হয়নি।
বেলুনগুলো এখন সামনে আসছে কেন
এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা জবাব হলো, বেলুনগুলো এখন সামনে আসছে; কারণ, এখন সেগুলোর খোঁজ করা হচ্ছে।
গত ৫০ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে প্রথম আকাশে অজ্ঞাত বস্তু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আলোচনা হয়। সেখানে দেশটির নৌবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক স্কট ডব্লিউ ব্রে আইনপ্রণেতাদের বলেন, বেলুন, ড্রোন এবং এ ধরনের নানা প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ আকাশে আগের চেয়ে বেশি অজ্ঞাত বস্তু দেখতে পাচ্ছে।
চলতি মাসে এসে স্কট ডব্লিউ ব্রের ওই বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণিত হলো। উত্তর যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনা বেলুনটি উড়ে আসতে দেখল সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মার্কিনরা। যদিও এর আগেও চীনা বেলুন যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে এবার প্রথম এ ধরনের বেলুন সাধারণ মার্কিনদের চোখে ধরা পড়েছে।
এদিকে চীনা ওই বেলুন সামনে আসার পর তৎপর হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাডারসহ শনাক্তকরণে নানা যন্ত্র নিয়ে জোরেশোরে মাঠে নেমেছে তারা। দ্রুতগতি থেকে ধীরগতির—আকাশে ভ্রমণ করা সব বস্তু খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। ফলে নতুন নতুন বেলুন সামনে আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বেলুন ঠেকাতে কি সাইড উইন্ডার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র
ছোট আকৃতির তিনটি বেলুন ধ্বংস করতে সাইড উইন্ডার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ নিয়ে রিপাবলিকান দলের সদস্যদের অভিযোগ, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে মার্কিন প্রেসিডেন্টের হাত নিশপিশ করছিল। তবে বাইডেন বলেছেন, চারটি বেলুনই বেসামরিক উড়োজাহাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই সেগুলোকে ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
বাইডেন জানান, আকাশে অজ্ঞাত বস্তু শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজন পড়লে গুলি বা ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংসের জন্য নিয়মনীতি তৈরি করছে তাঁর সরকার। এরই মধ্যে তিনি নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করতে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর অর্থ ভবিষ্যতেও বেলুন ধ্বংসে সাইডউইন্ডার বা এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে।