যুক্তরাষ্ট্রে সুপার টুয়েসডেতে নিজ নিজ দলের প্রাথমিক বাছাইপর্বে (প্রাইমারি ও ককাস) ডেমোক্র্যাট নেতা জো বাইডেন ও রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প দুজনই বেশ স্বস্তির জয় পেয়েছেন। এতে দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন বাইডেন ও ট্রাম্প।
প্রাথমিক বাছাইয়ে এমন জয়ের মধ্য দিয়ে ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতোই আগামী নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এ দুই নেতার মধ্যেই মূল লড়াইটা হতে পারে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাছাইপর্বে সাফল্যের আড়ালে কিছু সমস্যা ঢাকা পড়েছে। শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের দৌড়ে দুজনের ওপরই এসব সমস্যা প্রভাব ফেলবে।
মার্কিন নাগরিকেরা জর্জ ওয়াশিংটনের পর আর কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেননি। তবে এবার সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বাইডেন ও ট্রাম্পকে নিয়ে জনগণের মধ্যে যে অনীহা দেখা যাচ্ছে, তাতে তৃতীয় কোনো পক্ষের উত্থান ঘটার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে।
বয়স বেশি হওয়ায় ও ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধে নিজ ভূমিকা নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের অনেকে বাইডেনের ওপর ক্ষুব্ধ। সে কারণে সুপার টুয়েসডেতে বড় জয় পেলেও তা খুব একটা উদ্যাপন করতে পারছেন না তিনি। অন্যদিকে বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বিভক্ত হয়ে পড়া রিপাবলিকান পার্টিকে ট্রাম্প আদৌ ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দলটির সমর্থকদের অনেকে সন্দিহান।
বাইডেন ও ট্রাম্পকে নিয়ে এমন দোলাচলের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। ভোটারদেরও অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এবার বেশি করে তাঁদের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এখন পর্যন্ত যেসব অঙ্গরাজ্যে দলীয় বাছাইপর্বের ভোট হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, রিপাবলিকান পার্টির সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পকে নিয়ে দলের মধ্যে ঐক্য নেই। সাউথ ক্যারোলাইনা, আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী নিকি হ্যালির পক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ থেকে তিন-চতুর্থাংশ বুথফেরত জরিপে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে ট্রাম্প তাঁদের ভোট পাবেন না।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা আছে। এসব মামলায় ৯১টি অভিযোগ করা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এতে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ আরও জটিল হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকানদের প্রাথমিক বাছাইপর্বে প্রতি তিনজনে একজন ভোটার কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।
গত সোমবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প লিখেছেন, তিনি রিপাবলিকানদের ঐক্যবদ্ধ করতে চান। আবার একই সময়ে তিনি তাঁর দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নিকি হ্যালিকে কীভাবে পরাস্ত করেছেন, তা নিয়েও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তাঁর দাবি, হ্যালি ‘কট্টর বামপন্থী’ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন পেয়েছেন।
ডেমোক্র্যাট শিবিরের মধ্যে বাইডেনকে নিয়ে বিরোধিতা করার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে।
নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা কলেজের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালে যাঁরা বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন মনে করেন, ৮১ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট আর খুব একটা কাজ করতে পারবেন না। বয়সের কারণে তাঁর কার্যক্ষমতা কম হবে।
রিপাবলিকান পার্টির কৌশলনির্ধারক কলিন রিড স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি যদি এখন বাইডেনের শিবিরে থাকতাম, তবে তাঁরা এখন যে সাবধানবাণী দিচ্ছেন, তা আমি আরও জোরালোভাবে দিতাম।’
তবে বয়সের ওপর তো আর কারও হাত থাকে না। সে ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে বাইডেনের কিছু করার নেই। আরও একটি বিষয় নিয়ে চাপের মধ্যে আছেন বাইডেন—গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিশিগান অঙ্গরাজ্যে জিতেছিলেন বাইডেন। আর ২০১৬ সালে সেখানে জেতেন ট্রাম্প। গত মাসে এ অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট–দলীয় বাছাইপর্বে এক লাখের বেশি ভোটার ‘আনকমিটেড’ (প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়) ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ ব্যালটে প্রার্থীদের তালিকা থেকে কাউকে ভোট দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হননি তাঁরা। সুপার টুয়েসডেতেও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইপর্বে এমন ভোটের সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার থেকে ৮৮ হাজার পর্যন্ত।
সাউথ ক্যারোলাইনা, আইওয়া ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী নিকি হ্যালির পক্ষে যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ থেকে তিন-চতুর্থাংশ বুথফেরত জরিপে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাদের ভোট পাবেন না।
বাইডেনকে বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ‘অ্যাবানডন বাইডেন’ আন্দোলন পরিচালনা করছেন হাসান আবদেল সালাম। তিনি বলেন, ‘এ সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের।’ নিজের উদ্যোগে শুরু হওয়া আন্দোলনের প্রতি ইহুদি, আফ্রিকান আমেরিকান, লাতিনো ও তরুণ ভোটারদের সমর্থন চাইছেন সালাম।
মার্কিন নাগরিকেরা জর্জ ওয়াশিংটনের পর আর কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেননি। তবে এবার সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বাইডেন ও ট্রাম্পকে নিয়ে জনগণের মধ্যে যে অনীহা দেখা যাচ্ছে, তাতে তৃতীয় কোনো পক্ষের উত্থান ঘটার সম্ভাবনা জোরালো হয়ে উঠছে।
বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে এ শঙ্কা বেশি কাজ করছে। কারণ, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্রিন পার্টির প্রার্থী জিল স্টেইন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, জন এফ কেনেডির ভাতিজা রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে তিন ব্যক্তির লড়াইয়ে রূপ দিতে পারেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষের প্রার্থীদের ঠেকাতে বাইডেন ও ট্রাম্পকে নভেম্বরের মধ্যে নিজেদের বিরুদ্ধে ‘বিদ্রোহের’ মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে।
জর্জ ডব্লিউ বুশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাঁর প্রশাসনে কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন রাজনীতিবিষয়ক পরামর্শক কিথ নাহিগিয়ান। তিনি মনে করেন, রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র ট্রাম্প ও বাইডেনের জন্য বাধা হয়ে উঠতে পারেন। কারণ, এতে ভোটাররা এ দুজনকে বর্জন করে অন্য কাউকে সমর্থন করার সুযোগ পাবেন।
কিথ নাহিগিয়ান বলেন, ‘এখন এ দুই শিবির (ট্রাম্প ও বাইডেন) কীভাবে নিজেদের পক্ষে জনগণের সমর্থন ধরে রাখবে, সেটা তাদের ওপরই নির্ভর করছে।’