ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দুই বছর পার হয়েছে তখন। সেই সময় তিনি মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে গোপন এক অভিযান শুরুর অনুমোদন দেন। অভিযানের লক্ষ্য, চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় চীন সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ‘অতি গোপন’ এ অভিযান সম্পর্কে কেউ জানত না। এই অভিযান সম্পর্কে সরাসরি জানেন— এমন কয়েকজন সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
সাবেক তিন মার্কিন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্পের নির্দেশে গোপন এ অভিযানের জন্য সিআইএ একটি ছোট দল গঠন করে। ওই দলের সদস্যরা ভুয়া পরিচয়ে অনলাইন মাধ্যমে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালাতে শুরু করে। পাশাপাশি চীন নিয়ে মানহানিকর গোয়েন্দা তথ্য বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে ফাঁস করতে থাকে।
চীন গত দশকে বিশ্বজুড়ে দ্রুত তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্য চুক্তি এবং ব্যবসায় অংশীদারত্ব বাড়িয়েছে বেইজিং। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের পাল্টা একটি পক্ষ হিসেবে বিশ্বে চীনের আবির্ভাব ঘটে। চীনের ক্রমবর্ধমান এই প্রভাব মোকাবিলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো।
সূত্রগুলো জানিয়েছে, গোপন অভিযানে যুক্ত সিআইএ গুপ্তচরেরা চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে নেতিবাচক প্রচারণা চালান। সিআইএ এই প্রচার চালায় যে এসব নেতা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। এ ছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) দুর্নীতিতে জর্জরিত প্রকল্প বলে প্রচার চালানো হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে চীন সরকার অর্থের অপচয় করছে বলে প্রচার চালায় সিআইএ। এই প্রকল্পটির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শত শত কোটি ডলারের অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন।
সিআইএর এই অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাতে চাননি মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে তাঁরা জানান, ভুয়া পরিচয়ে চীন সরকারের মর্যাদাহানিকর গোয়েন্দা তথ্য ছড়ান সিআইএ গুপ্তচরেরা।
দুই সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জানান, এর প্রধান লক্ষ্য ছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো। এতে চীন সরকার বাধ্য হয়ে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণে আরও বেশি অর্থ ব্যয়ে বাধ্য হয়। এক মার্কিন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘আমাদের চাওয়া ছিল, তারা (চীন সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি) যেন এমন একটা কিছুর খোঁজ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্বই নেই।’
চীনবিরোধী এ অভিযানের বিষয়টি জানার পর সিআইএর সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। সেই গোপন অভিযান এখনো চলছে কি না, এবং এর লক্ষ্য ও প্রভাব কী, সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তবে সিআইএর মুখপাত্র চেলসি রবিনসন রয়টার্সের এসব প্রশ্নের বিষয়ে কোনো সাড়া দেননি।
বিষয়টি নিয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করে রয়টার্স। মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, চীনের বিরুদ্ধে সিআইএর এ ধরনের অভিযান এটা প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনমত গঠন করা যায় এমন সামাজিক ও সংবাদমাধ্যমকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করে অপতথ্য ছড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মনোভাবকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে থাকে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, বৈশ্বিক পরিসরে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন বছরের পর বছর ধরে গোপনে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বেইজিংয়ের এমন তৎপরতার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবেই সিআইএকে দিয়ে ওই অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। মূলত তারই অংশ ছিল সিআইএর চীনবিরোধী এ অভিযান। সিআইএর এ অভিযান স্নায়ুযুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। গত শতকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাব মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয়েছিল তখন যুক্তরাষ্ট্রকে। রাজনীতিতে এই ধরনের যুদ্ধ নিয়ে একটি বই লিখেছেন টিম ওয়েইনার। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধ আবারও ফিরে এসেছে।’
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই গোপন অভিযান এখনো চালু রেখেছেন কি না, সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স। বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র কেট ওয়াটার্সের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হওয়া হলে তিনি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
গোয়েন্দা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন এমন দুই ব্যক্তির সঙ্গে সিআইএর এ অভিযান নিয়ে কথা বলেছে রয়টার্স। তাঁরা বলেন, হোয়াইট হাউস থেকে সিআইকে এ ধরনের কোনো গোপন অভিযানের নির্দেশ দেওয়া হলে সাধারণত নতুন প্রেসিডেন্ট এলেও তা অব্যাহত থাকে।
আসছে নভেম্বরে হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি অনেকটা চূড়ান্ত। ট্রাম্প যদি আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাহলে চীনের বিরুদ্ধে তিনি আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবেন বলে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।