পদুবাইয়ের ‘বিজনেস টাইকুন’ হিসেবে পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশি মাহাতাবুর রহমান নাসির। জন্ম সিলেটের বিয়ানীবাজারের নাটেশ্বর গ্রামে। বাবার হাত ধরে সুগন্ধি ব্যবসায় নামেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন আল-হারমাইনের পারফিউম। তিনি বাংলাদেশে এনআরবি ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান। সিলেটে আল-হারামাইন হাসপাতাল ও আল-হারামাইন টি কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকের ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য। প্রবাসে আরও অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক
এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত।
মধ্যপ্রাচ্যে মাহাতাবুরের ব্যবসার ব্যাপকতা আর বিস্ময়কর উত্থান নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা একাধিক প্রতিবেদন করেছে। দুবাইয়ের খালিজ টাইমস তাঁকে নিয়েও নিবন্ধ ছেপেছে। আরব আমিরাতে বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। পরপর চারবার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বা সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। দুবাই ছেড়ে এখন বাংলাদেশে আল-হারামাইন সুগন্ধি উৎপাদন করতে চান। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ৬৫টি দেশে এই সুগন্ধি রপ্তানির স্বপ্ন দেখছেন মাহাতাবুর। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সফরকালে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
প্রথম আলো: সুগন্ধি ব্যবসায় আসলেন কীভাবে।
মাহাতাবুর রহমান: আমার বাবার নাম মরহুম মাওলানা কাজী আবদুল হক। খুব সাধারণভাবেই আমার জীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল। বাবার হাত ধরেই সুগন্ধি ব্যবসায় নেমেছি। সিলেটের বিয়ানীবাজারের নাটেশ্বর গ্রামে আমাদের বাড়ি। তবে পাশের সুজানগরে আগর কাঠ হতো। ওই আগর কাঠ দিয়ে অনেক মূল্যবান আঁতর হতো। কিন্তু বাংলাদেশে ওই আগর কাঠের বাজার ছিল না। ছিল ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে।
১৯৫৬ সালে আমার বাবা যখন প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে হজ করতে যান, তখন তিনি সঙ্গে করে বেশ কিছু আগর কাঠ নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন মধ্যপ্রাচ্যের মানুষসহ বাংলাদেশিদের মধ্যে আগরের বেশ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করেন তিনি। এই জনপ্রিয়তা দেখে বাবা সেখানে সুগন্ধির ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পবিত্র মক্কা নগরী থেকে সুগন্ধির ব্যবসা শুরু করেন। আমি ১৯৭৫ সালে প্রথমবার বাবার সঙ্গে সৌদি আরবে যাই। সে সময় আমি একেবারেই তরুণ। সবেমাত্র বিএ পরীক্ষা দিয়েছি। তখন আমাদের ব্যবসা ছিল সৌদি আরবে।
প্রথম আলো: ব্যবসায় আপনার বাবাই কী আপনার অনুপ্রেরণা?
মাহাতাবুর রহমান: আমার বাবা বলতেন, স্বপ্নের সীমা রেখ না। তিনি নিজে এই চর্চাও করতেন না। বাবার ব্যবসা ছিল আগর কাঠের। আমি ভারত থেকে সৌদি আরব যাওয়ার পথে দুবাইয়ে ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে ১ ঘণ্টার জন্য থেমেছিলাম। বিমান বন্দরের দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। এরপর আরও একবার আমি ট্রানজিট যাত্রী হিসেবে দুবাইয়ের বাজার ঘুরে দেখে ভাবছিলাম, এখানে একটি দোকান নেওয়া যায় কিনা। সেই যে বড় স্বপ্ন দেখলাম, সেখান থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
প্রথম আলো: সৌদি আরব থেকে দুবাই কীভাবে ব্যবসা শুরু করলেন?
মাহাতাবুর রহমান: সুগন্ধি ব্যবসায় সাফল্য ধরা দিতে খুব বেশি সময় লাগেনি আমার। ধীরে ধীরে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে থাকি। ওই যে বললাম, দুইবার দুবাই ট্রানজিট ছিল। তখন সেখানকার বাজার ঘুরে মনে হল, সৌদি আরবের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারলে মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ। এরপর আল-হারমাইনের পারফিউম উৎপাদন কেন্দ্রটি সৌদি আরব থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারের সহযোগিতায় দুবাইয়ের জনমানবহীন একটি মরু এলাকায় সরিয়ে নিই আমরা। যখন আমি ওই জমি বরাদ্দ পেলাম, তখন সেখানে কোনো মানুষের বসবাস ছিল না। ওই জমি ভরাট করে সুগন্ধি উৎপাদন শুরুর পর সেখানে এখন বিশাল কর্মজজ্ঞ। এরপরই সেখানে নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ওই এলাকায়।
প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাজারে এই ব্যবসায় কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন?
মাহাতাবুর রহমান: আমরা যখন মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা শুরু করি তখন আমাদের অনেক প্রতিযোগীই ছিল। এখনো আছে, তবে আমরা তাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছি। কারণ, আমাদের যে পণ্য সেটি সব সময় আধুনিক। সুগন্ধি যে শুধু উৎসব বা উপলক্ষে নয়, বরং প্রতিদিনের ব্যবহারের একটি পণ্য, সেটি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। সুগন্ধিকে স্বল্প মূল্যের পাত্রে বাজারজাত করণের বদলে আমরা এর আঙ্গিক বদলে দেওয়ার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করি। এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যে রাজপরিবারের উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহৃত হয় আমাদের পারফিউম গিফট বক্স। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো রাজপরিবারের অনুষ্ঠানে একেকজন ১ লাখ ডলারের সুগন্ধি উপহার বক্স কিনছেন। রাজপরিবারের তরফেও যখন অন্য কাউকে উপহার দেওয়া হয়, তখনো আমাদের আল-হারামাইন সুগন্ধিকে তারা গিফট বক্স হিসেবে ব্যবহার করেন। এভাবে আমরা এখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যের সুগন্ধি বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছি। তারপরও বলব, ব্যবসার মূল কেন্দ্র সংযুক্ত আরব আমিরাত হলেও বর্তমানে আমাদের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।
প্রথম আলো: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন
মাহাতাবুর রহমান: অনেক বছর বিদেশে কাটিয়েছি, এখনো কাটাচ্ছি। তবে আমি জীবনের শেষ সময়ে দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমি আমার মেধা দিয়ে যে ব্যবসায়িক সুনাম তৈরি করেছি, সুগন্ধি ব্যবসার বিশ্ব বাজারে অবস্থান করে নিয়েছি, আমি চাই সেই পণ্য এবার পরিচিত পাক ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ নামে। দেশে এক শ নতুন অর্থনৈতিক জোন এবং ইপিজেড দেওয়ার প্রস্তার করেছে সরকার। এর একটি যদি আমরা পাই, তাহলে বিশ্বে সুগন্ধির যে বাজার তার অনেকটা আমরা বাংলাদেশ থেকে উৎপাদন করতে পারব। সেখানে লেখা থাকবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এখন এই সুগন্ধি আমরা উৎপাদন করছি সৌদি আরব ও দুবাইয়ে। ওখান থেকেই আমরা বিশ্বের অনেক দেশে পাঠাচ্ছি।’