৯/১১-এর হামলা কেন আগাম বুঝতে পারেনি সিআইএ?

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ছিনতাই করা যাত্রীবাহী দুটি উড়োজাহাজে ধসে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, নিভে যায় হাজার হাজার প্রাণ। ছবি: রয়টার্স
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ছিনতাই করা যাত্রীবাহী দুটি উড়োজাহাজে ধসে গেল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, নিভে যায় হাজার হাজার প্রাণ। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হলো। তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, তারা কি আরও কিছু করতে পারত? আক্রমণের অনেক পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কেন সিআইএ সেসবের দিকে চোখ বুজে ছিল? এর আসল কারণ হতে পারে বহুমুখী।

৯/১১-এর আক্রমণের পরিকল্পনার সতর্কবার্তা চিহ্নিত করতে সিআইএ–এর ব্যর্থতা গোয়েন্দা ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। এর জন্য কমিশন হয়েছে, পর্যালোচনা হয়েছে, হয়েছে অভ্যন্তরীণ তদন্ত এবং আরও বহু কিছু।

এক পক্ষ বলছে, সিআইএ স্পষ্ট সব সতর্কবার্তা দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। আরেক পক্ষ যুক্তি দিচ্ছে যে, এ রকম ক্ষেত্রে হুমকি আগাম চিহ্নিত করা খুবই কঠিন, যা কিছু সম্ভব তার সবই সিআইএ করেছে।

কিন্তু দুই পক্ষের যদি ভুল হয়? যদি এমন হয় যে সিআইএ–এর এই ব্যর্থতার কারণ আরও সূক্ষ্ম। এতই সূক্ষ্ম যে আসলে দুই পক্ষের কেউই তা ধরতে পারছে না? যদি এমন হয় যে, এই সমস্যাটা আসলে গোয়েন্দা সংস্থার পরিধি ছাড়িয়ে আজকে হাজারো সংগঠন, অনেক সরকারকে নীরবে স্পর্শ করছে?

ভয়াবহ এই হামলায় প্রায় ৩ হাজার মানুষ মারা যান। ছবি: রয়টার্স

অনেকে বলছেন, এই আক্রমণের যে পরিকল্পনা, তার মধ্যেই একরকম পাগলামি আছে। কিন্তু কেউ কেউ আবার খোদ সিআইএ–এর অভ্যন্তরীণ কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বিশেষ করে এর নিয়োগ দেওয়ার পদ্ধতি ও নীতি নিয়ে। একটা সময় এই নিয়োগ দেওয়ার পদ্ধতি ছিল এক শিল্পের মতো ব্যাপার। প্রার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও আরও বহু রকমের পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হতো। আর সিআইএ যে ব্যতিক্রমী সব মানুষ নিয়োগ দিত, তাতে সন্দেহ নেই।

একজন ঝানু সিআইএ বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলছেন, ‘প্রধান দুটি পরীক্ষা ছিল প্রার্থীর বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষার জন্য স্যাট ধরনের পরীক্ষা। আর তার মানসিক অবস্থা যাচাই করতে করা হতো মানসিক সক্ষমতা পরীক্ষা।’ এই কঠিন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে প্রতি ২০ হাজার প্রার্থীর মধ্যে ১ জন টিকত। সবচেয়ে ভালো প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সিআইএ কোনো খুঁত রাখত না। কিন্তু দেখা যেত যে, অধিকাংশ নির্বাচিত ব্যক্তিরা সাদা, পুরুষ, অ্যাংলো-স্যাক্সন ও আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট। এটি একটি সাধারণ প্রবণতা।

নিয়োগ দেওয়ার সময় সাধারণত তাদেরই নির্বাচন করা হয়, যারা নিয়োগদাতাদের মতো দেখতে, যারা তাদের মতো ভাবে, দেখে। ১৯৬৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিআইএ–এর এক শাখায় কোনো কৃষ্ণাঙ্গ, ইহুদি বা নারী পেশাজীবী নেই, ক্যাথলিক আছে অল্প কয়েকজন। ১৯৬৭ সালের প্রতিবেদন বলছে, ১২ হাজার অ-কেরানি সিআইএ নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ২০ জনের কম আফ্রিকান-আমেরিকান ছিল। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সিআইএ সংখ্যালঘুদের নিয়োগ দিত না। আর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে সমকামীদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।

হামলার পৌনে দুই ঘণ্টার মাথায় ধসে পড়ে টুইন টাওয়ার। ছবি: রয়টার্স

১৯৮০ সালের দিকে সিআইএ–এর নিয়োগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে একজন লিখেছিলেন যে, এর ফলে ‘নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা দেখতে হতো একেবারে তাদের নিয়োগদাতাদের মতো, সাদা, প্রধানত অ্যাংলো-স্যাক্সন, মধ্য ও উচ্চবিত্ত; লিবারেল আর্ট কলেজে থেকে পাস করা।’ তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিল কম। অন্য জাতির, এমনকি যারা কিছুদিন আগে ইউরোপ থেকে অভিবাসী হয়েছে, তাদের সংখ্যাও ছিল খুব কম। এমনকি সিআইএ যাঁরা গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও বৈচিত্র্য ছিল এর চেয়ে বেশি। স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বৈচিত্র্য আরও কমিয়ে আনা হয়।

৯/১১-এর কয়েক মাস আগে দ্য ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স মন্তব্য করেছিল, ‘শুরু থেকেই গোয়েন্দা সংস্থায় ছিল শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ, প্রোটেস্ট্যান্ট অভিজাতদের প্রাধান্য। এর কারণ শুধু এই নয় যে—তারাই ছিল ক্ষমতায়, বরং এই অভিজাতরা নিজেদের আমেরিকান মূল্যবোধ ও নৈতিকতার রক্ষাকর্তা ভাবত।’

এই ‘এক রকম’ হওয়ার প্রবণতা কেন গুরুত্বপূর্ণ? দৌড় প্রতিযোগিতায় তো বর্ণ, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থানের চেয়ে যে দ্রুত দৌড়ায়, তারই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা! এমন সহজ যুক্তি ইন্টেলিজেন্সের মতো জটিল জিনিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সমস্যা যখন জটিল হয়, তখন কোনো এক ব্যক্তির পক্ষে তার সব উত্তর জানা সম্ভব নয়। আমাদের প্রত্যেকের বোঝাপড়ার মধ্যেই এমন কিছু জায়গা আছে, যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়।

এর মানে—আপনি যদি আপনার মতো একইভাবে দেখে বুঝে এমন সব লোককে নিয়োগ দেন, তাহলেও আপনার মতো তারও একই জিনিস নজর এড়িয়ে যেতে পারে। তখন সেই নজর এড়ানো জিনিস নজরে আসার বদলে, তা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আরও শক্তিশালী হবে।

দোর্দণ্ড প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক কেন্দ্রে হামলা চালানোর পর দম্ভভরে তার দায় স্বীকার করে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক আল-কায়েদা। এর প্রধান ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। ছবি: রয়টার্স

ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে তোরাবোরার এক গুহা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ছবিতে দেখা গেল, বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়ির এক লোক। তাঁর পরনে যুদ্ধ-পোশাক।

যে আতঙ্ক বিন লাদেন ডেকে এনেছিলেন, সে কথা জানা থাকার পর ওই যুদ্ধ ঘোষণার ছবি ভয়াবহ মনে হয়। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একজন ভেতরের লোক বলেছেন, সিআইএ ‘বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ক্যাম্পফায়ারের ধারে উবু হয়ে বসা দাড়িওয়ালা লম্বা এই সৌদি নাগরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি হতে পারে।’

তখনকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশ্লেষকদের চোখে বিন লাদেন ছিলেন আদিম একজন লোক, তেমন বিপজ্জনক নন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রিচার্ড হলব্রুক বলেছিলেন, ‘গুহার ভেতরে থাকা একজন লোক কেমন করে দুনিয়ার সবচেয়ে অগ্রসর যোগাযোগব্যবস্থাকে যোগাযোগের বাইরে নিয়ে যেতে পারে?’আরেকজন বলেছিলেন, গুহায় বাস করা একজন লোক আর আল-কায়েদা সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য জানার জন্য অর্থ খরচ করার কথা তাঁরা ভাবতেই পারছিলেন না।

এই জায়গায় সিআইএ ভুল করেছিল। তারা তাদের নিজেদের অভ্যস্ত চোখ দিয়ে বিন লাদেনকে আর তাঁর পদক্ষেপগুলো বুঝেছিল। তাঁর পোশাক, গুহার ভেতরে বসবাসের কারণ এই নয় যে তিনি বুদ্ধি বা প্রযুক্তিতে আদিম ছিলেন। তিনি আসলে তাঁর অনুসারীদের সামনে নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করছিলেন, যা তাঁর জন্য কার্যকর ছিল। লরেন্স রাইট ৯/১১ নিয়ে একটি বই লিখেছেন। বইটি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। সেখানে তিনি বলেছেন, বিন লাদেন তাঁর আক্রমণগুলো সমন্বয় করতেন এমন সব ছবি চোখের সামনে এনে, যেগুলো তাঁর অনুসারীদের কাছে গভীর অর্থ বহন করে। কিন্তু অপরদিকে সিআইএর কাছে এগুলোর দৃশ্যত কোনো অর্থ ছিল না। তারা নিজেদের সংস্কৃতি আর অভ্যাসের চোখে সেসব অপরিচিত প্রতীকের অর্থ করছিল। এর খেসারতও তাদের দিতে হয়েছে।

বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে

আরও পড়ুন: