প্রতি বছরের মতো এবারও ৬ মার্চ সারা বিশ্বে খ্রিষ্টান ক্যাথলিক মণ্ডলী শ্রদ্ধায় ভক্তিতে ও ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ‘ভস্ম বুধবার’ পালন করবে। কপালে ভস্ম বা ছাই মেখে যাজকগণ সাধারণ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেবেন,‘ হে মানব তোমার জন্ম যে ধুলায়, তুমি আবার সেই ধুলাতেই একদিন মিশে যাবে। এ জীবন নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর পর যে জীবন, সেটাই চিরস্থায়ী। সেই চিরস্থায়ী জীবনের নাম স্বর্গ এবং নরক। আমরা এই পৃথিবীতে যে যেমন কাজ করব, পরকালে সেই মতোই বিচার পাব। স্বর্গ বা নরকের চিরকালের বাসিন্দা হব। সে কারণে পার্থিব জীবনে ত্যাগস্বীকার, প্রার্থনা দানশীলতা খুবই দরকার।’
‘ভস্ম বুধবারে’র মধ্য দিয়েই সারা বিশ্বে ক্যাথলিক খ্রিষ্টমণ্ডলী প্রায়শ্চিত্তকাল বা তপস্যাকাল, অথবা আত্মশুদ্ধির কাল শুরু করে থাকে। দীর্ঘ ৪০ দিন নিজেদের প্রস্তুত করবে খ্রিষ্টভক্তরা। পবিত্র বাইবেলের মার্ক রচিত সুসমাচারের ১ অধ্যায়ের ১৩ পদে উল্লেখ আছে, ‘যিশু ৪০ দিন মরু প্রান্তরে রইলেন। সে সময় শয়তান তাঁকে যাচাই করার জন্য নানা প্রলোভনে ফেলতে চেষ্টা করল। উপবাস থাকার পর যখন তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল, তখনই শয়তান এল তাঁকে প্রলোভন দেখাতে। যিশুখ্রিষ্ট ঈশ্বরের পুত্র হলেও তাঁর মধ্যে মানবিক বিষয়ও উপস্থিত ছিল। ৪০ দিন উপবাসের পর তিনি যখন অনেক ক্ষুধার্ত, তখন শয়তান বুঝল এটাই উত্তম সময় তাঁকে প্রলোভনে ফেলার। কিন্তু যিশু সব প্রলোভনই জয় করলেন।’
শয়তানের প্রলোভনের চারটি দিক ছিল। প্রথমে সে যিশুকে দৈহিক খাদ্যের লোভ দেখিয়েছিল। তারপর ধনসম্পত্তির। এর পর দেখাল রাজত্বের লোভ। তারপর সে যিশুকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল; প্রমাণ চাইল সে ঈশ্বরের পুত্র কিনা। এমনকি পবিত্র বাইবেলের প্রবক্তাদের ভবিষ্যৎ বাণী নিয়েও চ্যালেঞ্জ করল শয়তান। কিন্তু যিশু সব প্রলোভনই জয় করেন। মূলত যিশুর এ ৪০ দিন উপবাস ও প্রার্থনার অনুসরণেই আমরা সারা বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানগণ ৬ মার্চ থেকে ৪০ দিন উপবাস, প্রার্থনা ও ত্যাগস্বীকার করে থাকি। এই সংযমের মূল লক্ষ্য আত্মশুদ্ধি। উপবাস অথবা রোজা আমাদের সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। শুধু দৈহিকভাবে খাদ্য না নিলেই রোজা অথবা উপবাস সম্পন্ন হয় না। উপবাসের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে প্রার্থনা করা, দান করা, পবিত্র জীবনযাপন করা, মানুষের উপকার করা, শত্রুকে ক্ষমা করা।
এই বিষয়ে পবিত্র বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচারে ৬ অধ্যায়ের ১৬ থেকে ১৮ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যখন উপোস করো, তখন ভণ্ডদের মতো বিষণ্ন ভাব দেখিও না। তারা যে উপোস করছে, তা লোকদের দেখাতেই তো তারা মুখখানা অমন শুকনো করে রাখে। আমি তোমাদের সত্যিই বলেছি, তাদের পুরস্কার তারা পেয়ে গেছে। যখন তুমি উপোস করো, তুমি বরং তখন মাথায় তেল মেখ, চোখ-মুখ পরিচ্ছন্ন রেখ, যাতে তোমার উপবাস অন্যরা জানতে না পারে। তাহলে তোমার পিতা যিনি গোপনে সবকিছু দেখতে পান, তিনিই তোমাকে পুরস্কৃত করবেন।’
লোক দেখানো উপবাস করা, মানুষকে বলে বেড়ানো অথবা এমন ভাব করা কিংবা প্রকাশ্যে নিজের ভালো কিছু বলে বেড়ানোর বিষয়ে তিনি সব সময় সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি দানশীলতার ব্যাপারে বলেছেন, ‘তুমি যখন দান করো, তখন তোমার ডান হাত কী করছে, বাম হাত যেন তা জানতে না পারে।’ অর্থাৎ দান করার ক্ষেত্রে আমরা যেন মানুষকে বলে না বেড়াই। আমাদের দান থাকবে গোপনে, যা শুধু ঈশ্বরই দেখবেন ও জানবেন এবং তিনিই আমাদের পুরস্কৃত করবেন। এসব পুরস্কার আমাদের জন্য সঞ্চিত থাকবে পরকালের জন্য।
এই ৪০ দিন উপবাস ও ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে আমরা খ্রিষ্টানগণ স্মরণ করি প্রভু যিশুর (ইসলাম ধর্মমতে ইসা নবী) যাতনাভোগ ও কষ্টের কথা। তিনি এ জগতে থাকাকালে যে বাণী প্রচার করেছেন, যে শিক্ষা দিয়েছেন, যেসব অলৌকিক কাজ করেছেন সবকিছুই আমাদের ধ্যানের বস্তু। সারা বিশ্বে ক্যাথলিক মণ্ডলী সারা বছরকে মোট পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। তার মধ্যে এই চল্লিশ দিনের সময়টাকে বলা হয় তপস্যাকাল বা প্রায়শ্চিত্তকাল। এই সময়ের মূল শিক্ষাই হলো ত্যাগস্বীকার, যেন সত্যিই আমরা তাঁর স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের যোগ্য হয়ে উঠতে পারি।
এই ৪০ দিনকে সাতটি সপ্তাহে ভাগ করা হয়েছে। ভস্ম বুধবারের মধ্য দিয়ে এর শুরু হয় ৬ মার্চ। এই সময়ে ক্যাথলিক মণ্ডলীর বিশ্বাসীরা কোনো ধরনের আনন্দ-উল্লাস করতে পারবে না। কোনো বিয়ে অথবা কোনো জাঁকজমক করা যাবে না। নিরামিষ খাওয়া অথবা মাংসাহার ত্যাগ করা, উপোস রাখা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বয়সের কিছু সীমা-পরিসীমায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সাতটি সপ্তাহের শেষ সপ্তাহটাকে বলা হয় সবচেয়ে পবিত্রতম সপ্তাহ। এই সপ্তাহে স্মরণ করা হয় যিশুখ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কথা। শেষ শুক্রবারটাকে বলা হয় গুড ফ্রাইডে। এই দিন যিশুখ্রিষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ঈশ্বরের পুত্র হয়েও তিনি ক্রুশে প্রাণ ত্যাগ করে প্রমাণ করেন মানুষের প্রতি পিতা ঈশ্বরের ভালোবাসা। তিনি আমাদের পাপের পরিত্রাণের জন্যই মূলত ক্রুশে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।
এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ হবে সেই দিন, যেদিন তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। সারা বিশ্বে পালিত হবে গুড ফ্রাইডে। তার তিন দিন পরই পালিত হবে পুনরুত্থানকাল। অর্থাৎ তিনি মৃত্যুকে জয় করে পুনরুত্থান করবেন। তিনি আবার বেঁচে উঠবেন। তাঁর এই পুনরুত্থানই হচ্ছে স্বর্গ ও নরকের সংযোগ। তিনি পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করেছেন মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, যা অনন্ত। যে জীবনের জন্য আমরা এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে ভালো ভালো কাজ করে সঞ্চিত করে রাখব পূণ্যধন। তাই এই তপস্যাকালেই মণ্ডলী আমাদের এই শিক্ষা দিতে চান। মৃত্যুর পর এ মাটির দেহটি যে ধুলায় মিশে যাবে, সে কথাই মূলত ৬ মার্চে কপালে ভস্ম লেপনের মধ্য দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেন। কারণ, মৃত্যু আমাদের জীবনে কখন আসবে, আমরা কেউ তা জানি না। সে জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার জন্যই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় এই নশ্বর জীবনের কথা। ৬ মার্চের এই শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের অনুধ্যান হোক।