হিরালী

দমকা বাতাসের তাণ্ডবে কুপির আলো বারবার নিভু নিভু করছে। সাথে বিজলি চমক যেন দিনের সূর্য থেকে ধার করা প্রজ্বলিত লেলিহান শিখা। হাওরের বেড়িবাঁধে পাহারাওয়ালা নৌকাগুলো আছড়াতে থাকে যেন পানির কুমিরের গলায় কেউ রশি বেঁধে রেখেছে, আর কুমিরটা ছুটে পালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় হাওরপারের মানুষগুলো দারুণ উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করে। হলুদ সবুজের মিশ্রণে পোয়াতি ধানের বাহারি রূপ পুরো হাওরটাকে মনে হয় ঢেউয়ের দোলায় দোলাচ্ছে। এক ফসল্যা কৃষকের পুরো বছরের স্বপ্ন-সাধ-আহ্লাদ জড়িত থাকে এই বোরো ফসলকে কেন্দ্র করে। তাই কাকের ডিমের রং ধারণ করা আকাশ দেখতে চায় না হাওরপারের মানুষগুলো।
গেল বছর যেভাবে রমিজ আলির স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল শিলাবৃষ্টি, আর অকাল বন্যা। আড়াই কুড়ি বয়সেও রমিজ আলি এমন নিদানে পড়েনি, এমন বেহাল দশা দেখেনি ধরমপুরের মানুষ। রমিজ আলির একমাত্র মেয়ে রাবুর বায়না ছিল, ফসল উঠায়ে কানের এক জোড়া সাগরিকা রিং কিনে দিতে হবে। মেয়ের বায়না শুনে কোনো কথা কয়নি রমিজ আলি। রাবুর মা জরিমন বলেছিল, মাইয়া যখন খায়েশ করিছে, দিবানে এক জোড়া রিং গড়িয়ে। রমিজ আলিও রাজি হয়েছিল। কিন্তু তাদের সব স্বপ্ন বানের জলে ভেসে গেল।
প্রথম দফায় আকাশ ভেঙে প্রচণ্ড বেগে শিল পড়তে লাগল। কে যেন আকাশ থেকে বরফ খণ্ড কেটে কেটে জমিনে ফেলে দিচ্ছে, আর সবগুলো শিলাখণ্ড মেপে মেপে পোয়াতি ধানের থুরের ওপরেই পড়েছে। তারপরেই নেমে এল পাহাড়ি ঢল; মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে এল ঢলের পানি। হুড়হুড় করে ভেঙে গেল বেড়িবাঁধ, মুহূর্তেই পানিশূন্য হাওর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেল। সেই ঢলের পানি যেন আর থামতে চায় না। ক্ষণে ক্ষণে যেন পানির আক্রোশ বেড়েই চলেছে। পাগলা পানি বারবার ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে রমিজ আলির স্বপ্নকে। সে নিঃশব্দে বসে পানির আকুলি-বিকুলি দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। যেন তার অপরাধেই অকাল বন্যা এসে গেল। একবার ফিরে তাকায়। দেখে তলিয়ে যাওয়া কাঁচাপাকা ধানের আকুতি। বুক ফেটে কান্না আসে রমিজ আলির। দীর্ঘশ্বাসে তপ্ত হয়ে ওঠে আকাশ বাতাস। ‘যত দূষ কপালের, নাইলে এ সময়ে পাকা ধানের মাড়াই চলত হাওরের প্রতিটি রাজাইলে।’
‘তৌবা তৌবা’ করে আল্লাহর দরবারে মাফি চায় হাওরপারের মানুষগুলো। সবাই মনে মনে দরুদ পাঠ করে। কোন গুনাহর কারণে আল্লাহতালা এমন গজব দিলেন কেউ বলতে পারে না। এরপরও কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না অসৎ ঠিকাদারদের বাঁধ নির্মাণে ত্রুটির কথা। ওরা তো হামেশাই জনস্বার্থকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেকে বিত্তবৈভবের পাহাড়ে তোলে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় নিজের আখের গোছায়। দলকে মোটা চাঁদা দিয়ে দলের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করে। কখনো নিজেই নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করে। আর ওই সব খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিককে তার তাবেদারি করতে বাধ্য করে। রমিজ আলি কসম খেয়ে বলেছে, বেড়িবাঁধের ঠিকাদারদের সে কখনো তোয়াজ করবে না। দরকার হয় গ্রামবাসীদের নিয়ে নিজেরা বাঁধের মেরামত করবে। আর শিলাবৃষ্টি রোধ করতে ওরা হিরাল (পির) ডাকবে। সত্যি সত্যি একদিন রমিজ আলি হাওরপারের প্রতিটি গ্রামে জনসংযোগ শুরু করে।
গঞ্জের হাটবারে এক জরুরি সভা ডেকে সবাইকে নিয়ে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে, হাওরপারের প্রত্যেক মানুষ পালা করে বাঁধ পাহারা দেবে। আর এই চৈত্র মাসেই তারা হিরাল ডেকে শিলাবৃষ্টি ঠেকাবার ব্যবস্থা করবে। গ্রামের কয়েকজন যুবক নিয়ে রমিজ আলি চলে গেল হিরালীর খুঁজে। এ গ্রাম থেকে ওই গ্রামে ঘুরে ঘুরে খোঁজ পেল শেষে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে শারফিন শাহের মোকামে এক বিশাল গুনি হিরালী থাকে। এ তল্লাটে তাঁর অনেক নামডাক। কিন্তু তাঁকে পাওয়া খুবই মুশকিল। লোকটা সব সময় ধ্যানমগ্ন থাকে। রমিজ আলি তাঁর সাথের যুবকদের নিয়ে অঙ্গীকার করে, যেমন করেই হোক তারা এই হিরালীকে নিয়েই ফিরবে।
একদিন সত্যিই তারা সন্ধান পেল। শাহ কালা চান নামে এক পাগল সামনের পাহাড়ে কদম গাছের নিচে বসে ধ্যানে মগ্ন। ধ্যান ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত রমিজ আলি সাথিদের নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। একসময় মগ্নতা শেষ হয় ধ্যানীর। রমিজ দেখে কঙ্কালসার দেহ নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন তার দিকে। মনে হলো গায়ের রং নীলাভ গৌর বর্ণ ছিল। এখন যদিও তা পোড়া ইটের রং ধারণ করেছে। চিকন পা দুটি শক্ত করে ধরে রেখেছে পুরো শরীরটাকে। হাত দুটো ঝুলে পড়েছে। ঝকঝকে কোটরগত চোখ দুটো স্থির তাকিয়ে আছে রমিজের দিকে।
রমিজ আলির কোনো ভয় কিংবা বিস্ময় নেই। শাহ কালা চান দু কদম এগিয়ে এসে রমিজদের সাক্ষাতের হেতু জানতে চাইলেন এবং রুপার থালে রাখা চারকোনা আকৃতির লালসালুর রুমালটি তুলে নিলেন কায়দা করে। তারপর ওই রুমাল দিয়ে দুচোখ বেঁধে আকাশের দিকে তাকিয়ে শাহ কালা চান মন্ত্র জপতে লাগলেন। তারপর রমিজ আলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘চলো ধরমপুরে আমি শাহ কালা চান, মন্ত্রবলে করব বিনাশ, পাথর গলে হবে পানি, সব শয়তানের মন্ত্র জানি।’ বিড়বিড় করে আরও কত কিছু তিনি বলে চলেছেন, তার সবকিছুর অর্থ রমিজ আলি খুঁজে পেল না।
একজন খুবই গুনি পিরের উপস্থিতিতে হাওরপারের সব গ্রামের মানুষ ধরমপুরের দিকে ছুটে আসতে লাগল। মানুষের মনে আতঙ্ক আর বিস্ময় কাজ করতে লাগল। ছেলে-বুড়ো ভিড় জমাল শাহ কালা চান পিরকে ঘিরে। সফেদ থান কাপড়ের এক প্রস্থ লুঙ্গির মতো পরা। লালসালুর আরেক প্রস্থ গায়ে জড়ানো। গলায় হরেক রকমের তসবির মালা। এলাকার নারী-পুরুষের অবাক করা চাহনি একসময় ধাতস্থ হলো।
হঠাৎ দেখা গেল ঈশান কোণের আকাশে ঘন মেঘের আনাগোনা। বিদ্যুতের চমক। চৈত্রের শেষের কাঠফাটা গরমের হিমশীতল ভাব। মনে হচ্ছে শিলাবৃষ্টি এই নামল বলে। এদিকে শাহ কালা চানের চেহারায় এক অলৌকিক পরিবর্তন দেখা গেল। তিনি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে এক সময় হাওরের সীমান্ত ধরে ছুটতে লাগলেন। গ্রামের কিছু সাহসী যুবক কালা চানের পিছু নিল। কিছু দূর এগিয়ে দেখা গেল, কালা চানের পরনের সাদা থান কাপড় তাঁর মাথায় পাগড়ির মতো কাজ করছে, আর লাল সালুটা নিশান আকারে বাতাসে উড়িয়ে চিৎকার করে ঝোড়ো হাওয়াকে গালি দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ এভাবে গালিগালাজ করার পর দেখা গেল ঝোড়ো বাতাসের প্রলয় অনেকটা কমতে লাগল। এটাই হয়তো প্রকৃতির নীতি। আর সবাই বলে পিরের কেরামতি।