৭ মে ২০১৯, মঙ্গলবার ৬৬ বছর বয়সে চলে গেলেন বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী! আমাদের কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে বেতার-টিভি-ক্যাসেটে-রেকর্ডে সুবীর নন্দীর গান গাওয়ার সূচনা। গানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা জন্মানোর বয়সে শুরু করেছিলেন বলে এবং বেছে বেছে ভালো বাণীর গান গাইতেন বলে তাঁর প্রতি একটা আলাদা অনুরাগ ছিল। তখন তো অতটা তলিয়ে জানতাম না যে, সিলেট অঞ্চলে জন্ম বলে ভাব ও সুর তাঁর জন্মসঙ্গী! এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর উচ্চাঙ্গ সংগীতের স্বনিষ্ঠ শিক্ষা ও সাধনা!
গানের মানুষদের কারও কারও সঙ্গে নানা সূত্রে আমার জানাশোনা থাকলেও সুবীর নন্দীর সঙ্গে আমার দূর থেকেই চেনাজানা। চ্যানেল আইয়ের ‘সেরাকণ্ঠ’ ও ‘ক্ষুদে গানরাজ’ সূত্রে তাঁকে চ্যানেল আইয়েও দেখেছি অনেকবার। এ রকম এখানে-ওখানে বহুবার দেখা হলেও প্রাসঙ্গিকতার সূত্র না থাকায় কথা হয়নি তেমন। ফলে আমি তাঁর কাছে চেনা কেউ ছিলাম না। কিন্তু নিউইয়র্কে বারবার আসতেন বলে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠমণ্ডলীর কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সূত্রে নিউইয়র্কে অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। কথাও হয়েছে একটু-আধটু। ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার। কিন্তু সে সুযোগ আর হলো না।
নিউইয়র্কে ২০১৭ সালে জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনলাম। তার পরপরই দেখা হলো তাঁর সঙ্গে জ্যাকসন হাইটসের এক পূজামণ্ডপে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলাম আমরা। হুমায়ূন কবীর ঢালীর মোবাইল সেলফিতে তার চিহ্নও রয়ে গেল! এই তো সেদিন, সরাসরি তাঁর গান শুনলাম ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠানে। সরাসরি মঞ্চের সামনে বসে এটাই তাঁর শেষ গান শোনা আমার। এর কিছুদিন পরই ২৪ জানুয়ারি নিউইয়র্কবাসীদের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো কুইন্স প্যালেসে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্কে এটাই ছিল তাঁর শেষ পরিবেশনা! এরপর তো তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক একুশে পদকে ভূষিত হলেন। তাঁর এই পুরস্কার পাওয়ায় নিউইয়র্কবাসী বাংলাদেশিদের অনেককেই আনন্দ প্রকাশ করতে শুনেছি।
তাঁর অসুস্থতার খবরে অনেককেই নিউইয়র্কে বিষণ্ন হতে দেখা গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে তাঁকে বিদেশে নেওয়ায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন সকলে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। তিনি চলেই গেলেন গানের মায়া ছেড়ে!
মনে পড়ছে, নিউইয়র্কের প্রবীণ সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান মাঝেমধ্যেই আড্ডায় তাঁর কথা তুলতেন। ইশতিয়াক রূপু যে প্রায়ই টেলিফোনে কথা বলতেন তাঁর সঙ্গে, তারও সাড়া পেতাম। বিভিন্ন প্রসঙ্গে উঠত তাঁর কথা। গান নিয়ে কথা উঠলে নিউইয়র্কের আপন মানুষ হিসেবে তাঁর কথা উঠতই। এর চিহ্ন পাওয়া যাবে সুবীর নন্দীর মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর মাহবুবুর রহমানের বা মিনহাজ আহমেদের স্ট্যাটাসে, ফারুক ফয়সলের শোকতাড়িত হয়ে কবিতা লিখে ফেলায়। এখানকার নানা সাংস্কৃতিক তৎপরতার সঙ্গে সুবীর নন্দীর ছিল প্রাণের যোগ। নিউইয়র্কের সংগীতপ্রেমী সংস্কৃতিকর্মীরা বসে নেই। ১২ মে রোববার, বিকেল ৩টা ৩০মিনিটে উদীচী যুক্তরাষ্ট্র স্মরণ করবে এই কিংবদন্তি শিল্পীকে। আমরা থাকব সেখানে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। সবাইকে এই স্মরণসভায় উপস্থিত থেকে শিল্পীর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানোর বিনীত অনুরোধ করেছেন উদীচীর আয়োজকেরা। স্মরণসভাটি হবে ৭৩১০, ৩৪ অ্যাভিনিউ, জ্যাকসন হাইটসের উদীচী স্কুলে।
না, কেবল স্মরণসভাই মূল নয়। তাঁকে আমরা স্মরণ করব তাঁর কর্মময় সংগীতজীবন ও আমাদের সংগীত-প্রাসঙ্গিক জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে।