মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলের পর পত্রিকার পাতায় দারিদ্র্য বা নানা বাধা-বিপত্তিকে জয় করে সাফল্য অর্জন করা অনেক শিক্ষার্থীর জীবনের গল্প দেখতে পাই। কিন্তু এ পর্যন্ত যাওয়ার আগেই যারা দারিদ্র্যের কাছে হার মেনে ঝরে যায়, তাদের খবর কে রাখে। পড়াশোনার মাঝে বিভিন্ন ধাপে শিক্ষার্থীদের এ ঝরে যাওয়া রোধে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বৃত্তি সহায়তা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি বৃত্তি ও স্বেচ্ছাসেবী বা দাতব্য সংগঠন থেকেও শিক্ষার্থীদের সহায়তার প্রয়াস চলছে। তেমনি একটি অলাভজনক দাতব্য সংগঠন হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
চন্দ্র নাথের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই চ্যারিটি ফাউন্ডেশন আগামী ১ ডিসেম্বর ৮ বছরে পদার্পণ করতে চলেছে। শৈশব থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে জীবনে সফলতা অর্জন করা চন্দ্র নাথ চেয়েছেন দারিদ্র্যের কাছে কোনো শিক্ষার্থীকে যেন হার না মানতে হয়। এ কারণে ২০১৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এই ফাউন্ডেশন। ম্যানুফ্যাকচারিং গবেষক চন্দ্র নাথ ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যে আরও দুজন বিশেষজ্ঞ মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন অ্যাডভান্সড ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটা স্টার্ট-আপ রিসার্চ এবং গবেষণা কোম্পানি মেইকার করপোরেশন। এর পাশাপাশি দেশ ও দেশের বাইরে একদল স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে চলছে এই অলাভজনক সংগঠনের কাজ।
চন্দ্র নাথ বলেন, প্রতিদিন কাজের মাঝেই আগের অর্থনৈতিক কষ্টের দিনগুলো প্রতিনিয়ত পীড়া দিত। এর স্থায়ী একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করেছি যেখানে সংযোগ হবে অনেক মানুষের। সেখানে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান কেউ নিজের ইচ্ছায় হাতটা বাড়িয়ে দেবেন, এক এক করে টেনে তুলবেন পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে লড়াই করতে থাকা শিক্ষার্থীদের। সেই অনুযায়ী গড়ে তোলা হয় ফাউন্ডেশন। শিক্ষা প্রকল্প ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের পাশে পুনর্বাসন প্রকল্প নিয়ে দাঁড়ানো, শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ ও জটিল রোগের চিকিৎসাসহ নানা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া রোধে এককালীন বৃত্তির সমন্বয়ে ১৩টি প্রকল্প চালু করেছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়/মেডিকেল ভর্তি প্রস্তুতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে এই চারটি স্তরে ২০২০ সালে প্রায় ৩৫০ এর বেশি শিক্ষার্থীকে মাসিক বৃত্তি প্রদান করা হয়, যার পরিমাণ প্রায় ৯১ লাখ টাকা। এককালীন বৃত্তি হিসেবে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ ৬৬ শিক্ষার্থীকে ১ লাখ ৪১ হাজার টাকা, উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি ফি ও শিক্ষাসামগ্রী বাবদ ৩০০ শিক্ষার্থীকে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণ বাবদ ১২৫ শিক্ষার্থীকে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম এবং যাতায়াত খরচের জন্য ১৫ শিক্ষার্থীকে প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ১৪৭ শিক্ষার্থীকে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছে।
মাধ্যমিক পর্যায়ে বার্ষিক মেধাবৃত্তি, প্রতিবন্ধী স্কুলে অনুদান, পাঠাগার নির্মাণ বা মেয়েদের স্কুলে অবকাঠামো সহায়তা প্রকল্পও চালিয়ে যাচ্ছে ফাউন্ডেশন। করোনায় মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা যেন পরিবারকে একটু স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে, সে জন্য আনা হয়েছে পারিবারিক পুনর্বাসন প্রকল্প। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১৫০ শিক্ষার্থীকে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়েও প্রায় সমপরিমাণ টাকার বাজেট ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ছাড় দেওয়া হবে। হিসাব করলে ২০২০ সালে এ ফাউন্ডেশন থেকে প্রায় ১২০০ শিক্ষার্থীকে ১ কোটি ২৯ লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে।
করোনাকালীন মহামারি সামাল দিতে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে সেবা চালু করে এই ফাউন্ডেশন। চন্দ্র নাথ বলেন, বাংলাদেশে ফাউন্ডেশনের একটা কমিটি এবং প্রায় প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় অনেক স্বেচ্ছাসেবী আছেন। শুধু বৃত্তি প্রদান করেই সংগঠনের কাজ শেষ হয় না। নিয়মিত প্রতিটি শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ও ফল খুবই ভালোভাবে নজরে রাখা হয়।
ফাউন্ডেশনের তহবিল মূলত আসে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি মানুষ বা কমিউনিটির মাধ্যমে। এ ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী কোনো সরকারি বৃত্তি কিংবা অনুদান ছাড়া অন্য কোনো সংগঠন থেকে বৃত্তির সুবিধা নিতে পারবে না। এই ফাউন্ডেশন থেকে বৃত্তি পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। এর মধ্যে চলতি বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাল্গুনী সাহা ‘সফল প্রতিবন্ধী নারী’ অ্যাওয়ার্ড ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাবিবা আকতার সর্বোচ্চ সিজিপিএ অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক পান।
সমাজে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এভাবেই হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্নের আলোকবর্তিকা নিয়ে বয়ে চলুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা চাই, এ রকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক।