ওপরের যে আকাশচুম্বী টাওয়ারটি দেখা যাচ্ছে, তার নাম কী বলুন তো? আপনি হুমড়ি খেয়ে হয়তো বলবেন, ‘আরে, জানি জানি। ও তো সিয়ার্স টাওয়ার, কে না জানে? এটা জিজ্ঞেস করার মতো কোন প্রশ্ন হলো?’ আসলে যা ভাবছেন, তা নয় কিন্তু। হ্যাঁ, এককালে হতো। তারপর শিকাগো নদীর ওপর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এক তো তখনকার পৃথিবীর সর্বোচ্চ টাওয়ারটি বানাতে সিয়ার্স-এর পকেট প্রায় ফুটো হয়ে গিয়েছিল। তার ওপর শিকাগো শহরের প্রাইম এরিয়ায়, প্রাইম বিল্ডিং-এ অনেক তলায় তাদের অফিস মেনটেইন করতে দেদার খরচা-খরচ হয়ে যাচ্ছিল। লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নিচ্ছিল। সে সময় সিয়ার্স কোম্পানিতে সব ইস্পাত ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপার্ট ছিল, অবিশ্যি আজও আছে। তাদের পরামর্শে সিয়ার্স শহর থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে, হফ্ম্যান এস্টেট নামে উত্তর-পশ্চিমের এক শহরতলিতে, তুলনায় পানির দামে পেল্লায় জায়গা কিনে ফেলল। কিনে সেখানে এক বিরাট মাল্টি পারপাস ‘সিয়ার্স সেন্টার’ বানায়। ১৯৯২ সালে তাদের অফিস সেই নতুন জায়গায় স্থানান্তর করে।
২০০৪ সালে জোসেফ চেট্রিট, জোসেফ মৈনিয়ান এবং ল্যান্ডমার্ক প্রপার্টিজ মিলে সিয়ার্স টাওয়ারটি ৮৪ কোটি ডলারে কেনে। পরে ২০০৯ সালে ইন্স্যুরেন্স ব্রোকার উইলিস গ্রুপ সিয়ার্স-এর কাছ থেকে ‘উইলিস টাওয়ার’ নামটা লিজ নেয়। তখন থেকে সিয়ার্স টাওয়ারের নাম বদলে তা হয়েছে ‘উইলিস টাওয়ার’, যদিও এখনো ওটাকে অনেকেই সিয়ার্স টাওয়ারই বলে। আমরাও। বর্তমান মালিক হলো ব্ল্যাক স্টোন গ্রুপ, যারা ওটাকে চড়া দামে ১৩০ কোটি ডলারে কিনেছে।
প্রাকৃতিক নিয়মে অনেক দিন ধরে দেখতে দেখতে, বলতে বলতে, মানুষ অনেক অজৈব বস্তুর সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে। যেমন এখানে খুবই আপস্কেল একটা ডিপার্টমেন্ট স্টোর ছিল, নাম ‘মার্শাল ফিল্ডস’। তাদের কাপড়চোপড়, জুতো, পারফিউম, গয়না, খেলনা ছাড়াও একটা স্পেশাল ব্র্যান্ড চকলেট ছিল যেটি আমেরিকাজুড়ে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর নিউইয়র্কের মেসি’জ ওই স্টোরটা কিনে নেয়। মেসি’জ যদিও খুব আপস্কেল স্টোর, কিন্তু ওটা ছিল মার্শাল ফিল্ডস–এর একধাপ নিচে। তাই নতুন মনিবের হয়ে কাজ করতে কর্মচারীরা শুধু যে অপমানিত বোধ করল তাই নয়, একটু পুরোনোদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে বসল। আর ইয়ঙ্গার এমপ্লয়ীদের বেশির ভাগ রাগে–দুঃখে চাকরিই ছেড়ে দিল।
যাকগে, কাজের কথা হলো যখন এই টাওয়ারটি নির্মিত হয়, তখন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল এবং সেই মর্যাদা সে ১৯৮৩ থেকে ২০০৯ সাল, এই ২৫ বছর ধরে রেখেছিল। এই ১১০ তলা ভবনের উচ্চতা হলো ১ হাজার ৪৫০ ফুট বা ৪৪২ দশমিক ১ মিটার। এটি ২০১১ সালে বোমায় ধ্বংস নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারের চেয়েও উঁচু ছিল। অবশ্য উচ্চতায় একে ছাড়িয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার। ওই ভবন দুটি ৮৮ তলার হলেও তাদের উচ্চতা হলো ১ হাজার ৪৮৩ ফুট বা ৪৫১ দশমিক ৯ মিটার। এর পরে একের পর এক জগতের অন্যান্য জায়গায় স্কাই–স্ক্র্যাপার তৈরি হয়ে সিয়ার্স বা উইলিস টাওয়ারের পজিশন অনেক নিচে পড়ে যায়।
২০১৯ সালে সৌদির টাওয়ার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর প্রথম ১০টি টাওয়ারের অবস্থান হবে- কিংডম টাওয়ার, জেদ্দা ৩,২৮১ ফুট (১০০০+ মিটার), বুর্জ খলিফা, দুবাই ২,৭১৭ ফুট (৮২৮ মিটার), ঝাংনান সেন্টার, সুঝাউ ২,৩৯২ ফুট (৭২৯ মিটার), পিং আন ফাইন্যান্স সেন্টার, সেনঝেন ২,১৬৫ ফুট (৬৬০ মিটার), সিগনেচার টাওয়ার, জাকার্তা ২,০৯৩ ফুট (৬৩৮ মিটার), গ্রিনল্যান্ড সেন্টার, ইউহান ২,০৮৭ ফুট (৬৩৬ মিটার), সাংহাই টাওয়ার ২,০৭৩ ফুট (৬৩২ মিটার), রয়্যাল ক্লক টাওয়ার, মক্কা ১,৯৭২ ফুট (৬০১ মিটার), গোল্ডেন ফাইন্যান্স ১১৭, তিয়ানজিন, ১, ৯৫৭ ফুট (৫৯৭ মিটার) এবং পার্ল অফ দি নর্থ, শেনইয়াং ১,৮৫৪ ফুট (৫৬৫ মিটার)।
চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে উইলিস টাওয়ারটির বৃহত্তম ভাড়াটে হয়েছে ‘ইউনাইটেড এয়ার লাইনস’, এরা ২০টি তলা ভাড়া নিয়েছে। উইলিস গ্রুপ ও এক বিরাট ল’ ফার্ম অনেক ফ্লোর ভাড়া নিয়েছে। আগামী ২০১৯ ও ২০২০ সাল নাগাদ ফাইন্যান্সিয়াল জায়ান্ট ‘মরগ্যান স্ট্যানলি’ এখানে তাদের অন্যতম প্রধান অফিস বানানোর পরিকল্পনা করেছে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আগের সব ভবনের তুলনায় এই সিয়ার্স টাওয়ার সম্পূর্ণ নতুন নকশায় বানানো হয়েছিল। টেকনিক্যাল টার্মে বলা যায়, এতে প্যারালাল কলাম প্রিন্সিপল-এর প্রবর্তন করা হয়েছে। মানে পাশাপাশি সিলিন্ডার বা টিউব টাইপ একের পর এক স্তম্ভ দিয়ে এটি বানানো হয়েছে, যাতে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝা, ভূমিকম্প ইত্যাদিতে ভবন একেবারে নুয়ে গেলেও আবার সে আগের পজিশনে ফিরে আসতে পারে। অনেকটা আমাদের দেশে দারুণ ঝড়ের মাথায় বাঁশঝাড়ের যে অবস্থা হয়। সেই থেকে এই ধারনায় পৃথিবীর সব স্কাই স্ক্র্যাপার বা উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে। মূলত, বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফাও এই একই কনসেপ্টে বানানো হয়েছে। ওটা দেখতেও অনেকটা সিয়ার্স টাওয়ারের বড় ভাইয়ের মতো।
আর এই যুগান্তকারী নকশার উদ্ভাবক কে জানেন তো? তিনি আমাদের বাংলাদেশের কৃতি সন্তান ড. ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান হিসেবে বেশি পরিচিত), শিকাগোর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। তিনি শিকাগোর বিখ্যাত আর্কিটেকচারাল ফার্ম স্কিডমোর, উইংস অ্যান্ড মেরিল-এর চিফ আর্কিটেক্ট বা প্রধান স্থপতি থেকে পরে মালিকানা অংশীদার হয়েছিলেন। সম্ভবত, বাংলাদেশের সাইক্লোনে বাঁশঝাড়ের টেনাসিটি তাঁর এই অভিনব নকশা আবিষ্কার করতে প্রভাবিত করেছিল।