যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের কর্মীরা একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে ঘোষণা করেছে। ৮ জুন সিয়াটল পুলিশের ইস্ট প্রিসিংক্ট ভবন খালি করে পুলিশ বাহিনী চলে গেলে তা দখলে নেয় আন্দোলনকারীরা। ভবনটিতে তারা স্প্রে পেইন্ট দিয়ে লিখে দিয়েছে, ‘সিয়াটল পিপল ডিপার্টমেন্ট’। গত শুক্রবার সিয়াটল পুলিশের ইস্ট প্রিসিংক্ট ভবনসহ এর আশপাশের ছয়টি ব্লককে ‘স্বায়ত্তশাসিত’ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা।
গত ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আন্দোলনের ঢেউ ওঠে। বর্ণবাদবিরোধী এই আন্দোলন পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে দেরি করেনি। একই সময়ে দাবি ওঠে পুলিশের অর্থায়ন বন্ধের। এরই মধ্যে সিয়াটলে আন্দোলনকারীরা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসিত ঘোষণা করে, সেখানে পুলিশকে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে ঘোষণা করেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, গত সপ্তাহে সিয়াটলের ক্যাপিটল হিল এলাকায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা ছিল মুখোমুখি অবস্থানে। টানা কয়েক দিনের এই মুখোমুখি অবস্থানের সমাপ্তি হয়, যখন সিয়াটল পুলিশ তাদের ইস্ট প্রিসিংক্ট ভবন থেকে সরে পড়ে। পরে আন্দোলনকারীরা ভবনটি দখলে নিয়ে আশপাশের ছয়টি ব্লক নিয়ে নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে। একে তারা ক্যাপিটল হিল অটোনমাস জোন বা চ্যাজ নামে অভিহিত করছে।
স্বায়ত্তশাসিত এই অঞ্চলটি নিউইয়র্কের জুকোটি পার্কের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। ‘উই আর ৯৯ পারসেন্ট’ স্লোগান তুলে যে ‘ওকিউপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন’ ২০১১ সালে হয়েছিল, সেখানেও আন্দোলনকরীরা একটি অঞ্চলকে নিজেদের বলে ঘোষণা করেছিল। জুকোটি পার্কে শুরু হওয়া সেই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই সিয়াটলেই। আগের মতোই এবারও সিয়াটলের এই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে চলছে গান, কবিতা ও চিত্রকর্মের এক উৎসব বলা যায়। আন্দোলনকারীদের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে আসছে খাবার, চিকিৎসাসেবার জন্য রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। রাস্তাগুলো তাঁরা রাঙিয়ে দিচ্ছেন নানা ছবি, স্লোগান ও প্রতিবাদী শব্দমালায়।
মূলত জায়গাটি দখলে কাজটি শুরু হয়েছিল আগেই। একটানা সহিংসতা চলেছে। পুলিশও চড়াও হয়েছে আন্দোলনকারীদের ওপর। কাঁদানে গ্যাসের শেল বা শব্দবোমা ছুড়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারপর পুলিশ নিজেদের কিছুটা সংবরণ করে। এই পরিস্থিতিতে সপ্তাহজুড়ে মুখোমুখি অবস্থানের শেষ দিকেই পুলিশ জায়গাটি ছেড়ে চলে যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আরও বিরূপ পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সে জন্যই তারা সরে পড়ে।
আজ রোববার স্বায়ত্তশাসিত ওই অঞ্চলে এসে অন্য সবার মতো যোগ দিয়েছেন ট্রেসি স্টুয়ার্ট নামের এক নারী। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডেকে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কৃষ্ণাঙ্গদের লাশ কেন পড়ে থাকবে? এখানে যারা এসেছে, তাদের সবাই হয়তো এই জমায়েতের কারণটি সম্পর্কে অবগত নয়। কিন্তু স্বাধীনতার বোধটি দ্বারা এদের সবাই তাড়িত।’
এদিকে স্বায়ত্তশাসিত ওই অঞ্চলের উৎসবমুখর পরিস্থিতি দেখে কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনকারীদের অনেকের মনেই এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে যে, আন্দোলনে যোগ দেওয়া শ্বেতাঙ্গ সবাই এই ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে পারছে কিনা।
ইউএসএ টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিয়াটলের অধিবাসীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। মাত্র ৬ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। এই কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে সিয়াটল পুলিশের বিরুদ্ধে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন সিয়াটল পুলিশের কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নেয়। এতে পুলিশের বলপ্রয়োগের ঘটনা ৬০ শতাংশ কমে। গত মে মাসের শুরুতে নগর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সিয়াটল পুলিশের ওপর থাকা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার আবেদন করা হয় ফেডারেল বিচারকের কাছে। যুক্তি ছিল, সিয়াটল পুলিশ এখন আর বর্ণবাদী নয়। কিন্তু এর ১৮ দিনের মাথায় মিনিয়াপোলিসে ঘটে জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ড শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় সারা বিশ্বেই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ তোলে। জ্বলে ওঠে সিয়াটলও।
সিয়াটলে ৩০ মে থেকেই শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। সহিংসতা, লুট ইত্যাদি যখন চলতে থাকে, ঠিক সে সময়ই একটি ভিডিও প্রকাশ পায়, যেখানে সিয়াটল পুলিশের এক কর্মকর্তাকে দেখা যায় এক ব্যক্তির ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়ে রয়েছে। ফলে আন্দোলনের তেজ বাড়তে সময় লাগেনি। এভাবে চলতে থাকে। শেষে ৮ জুন পুলিশ ইস্ট প্রিসিংক্ট থেকে সরে পড়ে। প্রিসিংক্ট ভবনটি দখলে নিয়ে আন্দোলনকারীরা স্প্রে পেইন্ট দিয়ে সেখানে লিখে দেয় ‘সিয়াটল পিপল ডিপার্টমেন্ট’।
এখন পর্যন্ত ওই এলাকা পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কোনো চেষ্টা পুলিশ করেনি। ওই এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন দিক দেখভাল করতে এখন পর্যন্ত নগরীর মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা একাধিকবার জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। এ সম্পর্কিত এক সাক্ষাৎকারে সিয়াটল পুলিশের প্রধান কারমেন বেস্ট স্থানীয় টিভি চ্যানেল কিং-ফাইভকে বলেন, এলাকাটি কবে আবার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আগে থেকে দিন-তারিখ ঠিক করা যাবে না।
সিয়াটলে অন্তত ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনটি যাবতীয় বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে আর্থিক পুনর্গঠনের ডাক দেওয়া হয়েছে। এতে যেমন রয়েছে পুলিশ খাতে অর্থায়ন হ্রাসের কথা, তেমনি রয়েছে জেফ বেজোসের মতো যারা অতি ধনী, তাঁদের ওপর স্থানীয় কমিউনিটির পেছনে আরও বেশি ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা আরোপের বিষয়টি। সোজাসাপ্টা কথা, ‘সম অধিকারের প্রশ্নেই এই আন্দোলন।’
সিয়াটলের মেয়র জেনি ডারকান এই আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এখন কথা বলার সময় নয়। কথা অনেক হয়েছে। এখন কাজের সময়। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রশ্নে আমি কী করছি, তা জনগণই দেখবে।’
সিয়াটল মেয়রের এমন অবস্থানে ব্যাপক চটেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত শুক্রবারই ট্রাম্প এ সম্পর্কিত এক টুইটে লেখেন, ‘লোকেরা আমাদের নগর পুড়িয়ে দিচ্ছে, আর তারা একে মনে করছে দারুণ।’