প্রবাসে একটি সাহিত্য সংগঠনের শততম আসর পূর্তি আয়োজন একটি অসামান্য ব্যাপার। এই অনন্য ঘটনাটি ঘটছে আজ ২৯ মার্চ, শুক্রবার, জ্যাকসন হাইটসের এক পার্টি হলে। শততম আসরকে স্মরণীয় করে রাখতে সাহিত্য পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শুভেচ্ছা বক্তব্য ও বিশেষ নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে।
সাহিত্য একাডেমির যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালে কয়েকজন সাহিত্যমনস্ক মানুষের ভালোবাসা থেকে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যিনি, বর্তমানে তিনি সংগঠনের পরিচালক, সেই মোশাররফ হোসেন উত্তর আমেরিকা প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেন, ‘সাহিত্য একাডেমির নিয়মিত আসরে শততম বর্ষপূর্তি অবশ্যই একটি আনন্দময় ঘটনা। তবে এখানে আমি থেমে পড়তে রাজি নই। ভবিষ্যতে সংগঠনের পক্ষ থেকে সাহিত্য পত্রিকা ও একটি একাডেমি গঠনের ইচ্ছা আছে।’ সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত কবি কাজী আতিক বলেন, ‘এটি এমন একটি সংগঠন যেখানে সবার সমানভাবে কাজ করার সুযোগ আছে। এখানে মুক্তবুদ্ধির-মুক্তচিন্তার চর্চা হয়।’ সেই প্রায় প্রথম থেকে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত লেখক সোনিয়া কাদের বলেন, ‘আমার এত ভালো লাগছে যে বলার নয়। আমি প্রিয় সংগঠনকে ভালোবেসে অনেককে এখানে এনেছি। তাদের মধ্য থেকে এখন অনেকে ভালো করছে, এটাই আমার বড় আনন্দের।’
সাহিত্য একাডেমির জন্ম হয় ২০১০ সালের শেষের দিকে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মোহাম্মদ মনসুর আলী এক লেখায় জানিয়েছিলেন, অন্য একটি সাহিত্য সংগঠনের সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি এসেছিলেন জ্যাকসন হাইটসের সেভেন্টি ফোর স্ট্রিটে। ওখানে তাঁর সঙ্গে বর্তমান পরিচালক মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। কারণ ওই জায়গাটি ছিল মোশাররফ হোসেনের মালিকানাধীন। কোনো কারণে ওই দিন সংগঠনটির সভা হয়নি এবং ভবিষ্যতে কখনো হবে না বলে জানানো হয়। পরে তিনি মোশাররফ হোসেনকে প্রস্তাব দেন নতুন একটি সংগঠন করার। এভাবে বীজ বপন হয়। তৃতীয় আসরে সংগঠনের নাম চূড়ান্ত হয়- সাহিত্য একাডেমি। নামটি মোশাররফ হোসেনই দিয়েছিলেন। এভাবেই যে বীজটি বপন হয়েছিল, সেটাই এখন মহীরূহে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয় আসর থেকে সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে যুক্ত সোনিয়া কাদের বলেন, ‘আমি তখন বাংলাদেশে ছিলাম। নিউইয়র্কে এসে জুলি রহমানের কাছে জানলাম, এখানে সাহিত্য একাডেমি নামে একটি সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছে। তারপর তৃতীয় আসর থেকেই আমি এখানে নিয়মিত আছি। ভাবতে খুব ভালো লাগছে সেই সংগঠনটি এখন ১০০তম আসর করতে চলেছে। এই আনন্দের কোনো সীমা–পরিসীমা নেই। আমি সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে ব্রঙ্কস থেকে বহুজনকে জ্যাকসন হাইটসে সংগঠনের সভায় নিয়ে এসেছি। তাদের অনেকে আগে লেখালেখি করত না। সাহিত্য একাডেমিতে এসে লেখালেখি শুরু করেছে। এটাই আমার ভালো লাগা। আমি নিজে হয়তো বিখ্যাত হতে পারিনি, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে হয়তো অনেক নামকরা হবে একদিন।’
‘প্রবাসে একটি সংগঠন নিরবচ্ছিন্নভাবে শততম সভা করতে পারাটা একটি অসামান্য ঘটনা’—বলেন সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যার সেই কবি কাজি আতিক। সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালের নভেম্বরে আমি সাহিত্য একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হই। তখন পর্যন্ত এ সংগঠনের ২৩টি আসর হয়ে গেছে। তবে তখনো সেভাবে কোনো কাঠামো দাঁড়ায়নি। তারপর থেকে আমি এখানে আছি। আশা করি আজীবন থাকব।’ সাহিত্য একাডেমি অন্য সংগঠনের চেয়ে কোথায় আলাদা জানতে চাইলে কাজী আতিক বলেছেন, ‘নিউইয়র্কে মানুষ এত ব্যস্ততার মধ্যে একটি জায়গায় নিয়মিত আসছে, যেখানে সেভাবে পাওয়ার কিছু নাই, এটা আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে। এটি নির্দিষ্ট কারও সংগঠন নয়, এটি সবার। একই ভাবনার ও মুক্তবুদ্ধির অধিকারী কতিপয় মানুষের জায়গা। যে নতুন, যে প্রথম এসেছে, তাকেও এখানে সমান সুযোগ করে দেওয়া হয়, যেটা আমার অসাধারণ মনে হয়।’
সাহিত্য একাডেমির শততম আসর নিয়ে সংগঠনের পরিচালক ও সংগঠক মোশাররফ হোসেন আনন্দিত কিন্তু বিগলিত নন। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর। অবশ্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। কিন্তু এত অল্পতে আমি সন্তুষ্ট হতে চাই না। ভবিষ্যতে এখান থেকে একটি ভালো মানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের স্বপ্ন দেখি আমি। একটি একাডেমি গঠনের প্রত্যাশা রাখি। ভাবি একটি নিজস্ব জায়গার। যদি জিজ্ঞাসা করেন, সাহিত্য একাডেমির ঠিকানা কি? কোনো উত্তর দিতে পারব না। এভাবে ভাসমান একটি সংগঠনের পক্ষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছু করা সম্ভব নয়। সে জন্য দরকার পায়ের নিচে একটি শক্ত মাটি। যেটা হলে যখন আমরা থাকব না, তখনো সাহিত্য একাডেমি তার কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারে। এমন একটি শক্তিশালী জায়গায় সাহিত্য একাডেমিকে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।’
সাহিত্য একাডেমির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্য ও আমেরিকার মূলধারার সাহিত্যের সঙ্গে সেতুবন্ধন করতে চান মোশাররফ হোসেন। ‘এটাকে একটি একাডেমিতে রূপান্তর করতে চাই এই ভেবে যে সবকিছুর একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দরকার। এখানে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ হবে। আবার বিদেশি সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ হবে। গবেষণা ও চর্চার একটি জায়গা হবে সাহিত্য একাডেমি। আড্ডা হবে, সৃষ্টিশীল কাজ হবে। নিউইয়র্কে বাঙালি অভিবাসীদের আগমন ও তাদের সংগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হবে। ধরা যাক, কোনো আমেরিকান বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করতে চাইছেন, তাকে তো এক জায়গায় আসতে হবে, সেই জায়গা এখানে কোথায় আছে, তেমন একটি জায়গা হতে চায় সাহিত্য একাডেমি।’
মোশাররফ হোসেন আরও বলেন, ‘সাহিত্য একাডেমির একটি নিজস্ব জায়গা হলে বাংলাদেশ থেকে লেখকেরা যখন নিউইয়র্কে আসবেন, তখন তারা সেখানে থাকতে পারবেন। আবার এখানে থেকে তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে জন্মভূমিকে জানার জন্য। জুইশ সেন্টার যে কাজটা বহু বছর ধরে করছে। তারা তরুণদের ইসরায়েলে পাঠায় শিকড়ের সন্ধানে। আমরা কেন সেরকম কিছু করতে পারি না। জানি সাহিত্য একাডেমিকে ঘিরে আমার পরিকল্পনাগুলি অর্জন করা সহজ নয়। কিন্তু অসম্ভবও কিছু নয়। লক্ষ্য স্থির রাখলে নিশ্চয়ই একদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারব।’