করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) কেড়ে নিয়েছে সিলেটের রাজনীতিতে সবচেয়ে পরিচিতি মুখ, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে (৬৯)। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জুন দিবাগত রাত তিনটার দিকে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
বড় অসময়ে চলে গেলেন এই সিলেটের সহনশীল রাজনীতির প্রতীক এই মানুষটি। তার সঙ্গে অনেক স্মৃতি না থাকলেও সিলেট শহরের সন্তান আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে কামরানের সঙ্গে ওঠাবকসা ছিল। কাছ থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
পঁচাত্তর পরবর্তী কোন এক সময়।
আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের দিন। রাজনীতির কঠিন সময়। ছাত্র রাজনীতিতে তখন আমাদের গুরু ম আ মুক্তাদির। কপর্দকহীন বোহিমিয়ান মানুষ। সে সময়ের ঝাঁকড়া চুলে একটা ভাব নিয়ে দিন বদলের স্লোগান আমাদের কণ্ঠে। সকাল থেকেই আমাদের রাজনৈতিক পথ চলা শুরু হতো। প্রতিদিন কোন না কোন কাজ, কোন না কোন গণসংযোগ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে অন্যের মুখ দেখি।
খিদে পেয়েছে। পকেটে টাকা নেই কারও।
অবস্থানটা জিন্দাবাজারের কাছাকাছি হলে সিরাজ (রূপবান সিরাজ) ভাইয়ের বাসায়। যেন কয়েকজনের খাবার তৈরি হয়ে আছে। জিন্দাবাজারে না হলে, আমাদের গন্তব্য তখন শহরের ছড়ার পার এলাকার দিকে। ম আ মুক্তাদিরের বন্ধু গোলাম মওলা, ফখরুল ইসলাম খানসহ আমাদের রাজনৈতিক কিছু শুভানুধ্যায়ী ব্যবসায়ীরা থাকেন এলাকাটিতে। অসময় বাসায় আমরা হানা দিতাম নেহাত উদরপূর্তির জন্য।
যত দূর মনে পড়ে এমন এক দুপুরে ম আ মুক্তাদির পরিচয় করে দেন সুদর্শন যুবক কামরানের সঙ্গে। সিলেট পৌরসভার কাউন্সিলর হিসেবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। দেশের রাজনীতি তখন নানা বাঁকে যাচ্ছে। একাত্তরের পরাজিত লোকজন মুখোশ তুলে বেরিয়ে আসছে। তাদের সঙ্গে সহাবস্থান হয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করে তৎকালীন জাসদের নেতা–কর্মীদের অবস্থাও অনেকটা দিশেহারা। টের পাওয়া যাচ্ছিল অনেক কিছুই। তারপরও জাসদের ছাত্র সংগঠন শহরে খুবই সংগঠিত ও শক্তিশালী তখন।
আন্দোলনের তখন নানা ফ্রন্ট। রাজনীতিও খুব সরল পথে যাচ্ছিল না। নগর কেন্দ্রিক নানা রাজনৈতিক কোলাহলে আমাদের জড়িয়ে যাওয়ার সময়। সিলেটের রাজনৈতিক ঐতিহ্যটাও আলাদা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন যারা, তাদের আশপাশে থেকেই একজন বাবরুল হোসেন উঠে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ ফেরত সুদর্শন তিনি। দীর্ঘদেহী, চমৎকার বক্তৃতা করেন। আমাদের নিশ্চিত ধারণা ছিল, বাবুলই হচ্ছেন সিলেটের পরবর্তী নেতা।
ছড়ার পারে আমাদের আনাগোনা অব্যাহত থাকে। জানতে পারি, কামরান মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছেন।
প্রবাসমুখিতা সিলেট অঞ্চলের জন্য ভালোর চেয়ে মন্দই মনে করেছি তখন। মেধাবী লোকজন বিদেশ চলে যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠেও তখন বেশ কিছু আলোচিত লোকজন কেউ চলে গেছেন জার্মানিতে, কেউ চলে গেছেন লন্ডনে। রাজনৈতিক এসব সংগঠক কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃত হয়ে পড়ছেন। দ্রুত পরিবর্তনের রাজনীতিতে নতুন নতুন লোকের সমাবেশ ঘটছে। কিছুদিন প্রবাসে থাকার পর এসব সংগঠকের কেউ কেউ ফিরেও আসেন। তত দিনে জল গড়িয়ে যায়। নিজেদের দলেই আর অবস্থান ধরে রাখতে পারেন না। এর মধ্যে দলীয় ঘরানার বাইরে কামরানকে কেউ মনে রেখেছিলেন কি না, আমার জানা নেই।
রাজনৈতিক আড্ডায় মাঝে মধ্যে প্রায় বিস্মৃত এক তরুণ সংগঠকের নাম হিসেবে আমরা বদর উদ্দিন কামরানকে নিয়ে আলোচনা করেছি কদাচিৎ।
এর মধ্যে বাবরুল আওয়ামী লীগ ছাড়লেন বা দলে টিকতে পারলেন না। রাজনীতিতে অন্য দলের লোকজনের সঙ্গে নয়, নিজ দলের মধ্যে লড়াই করে টিকে থাকার সংগ্রামটা তখন আমাদের কাছে প্রকাশ্য হতে লাগল। আজও অনেক সংগঠককে বলতে শুনি, রাজনীতিতে অন্য দল নয়, নেতৃত্বের এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজ দলের লোকজনই প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সিলেটের শুধু আওয়ামী লীগ নয়, অন্য দলেরও বেশ কিছু নেতা প্রবাসী হলেন। কয়েক বছর পরে ফিরলেও দলেই আর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেননি। ব্যতিক্রম ছিলেন বদর উদ্দিন কামরান।
সিলেটে আওয়ামী লীগের তখন বেশ দুর্দিনই চলছিল। ’৮৪ সালের পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা সাদত খান ছিলেন প্রার্থী। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি থেকে আসা অ্যাডভোকেট আ ফ ম কামাল সিলেট শহরের স্থানীয় লোক। রাজনীতিতে নিজেই দাঁড়ালেন শহরভিত্তিক নানা ক্লাব, সংগঠনকে সংগঠিত করে। মিছিল সমাবেশে এগিয়ে থাকা বাম দলগুলো নাগরিক কমিটি গঠন করলেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবাই মিলে। প্রার্থী করা হলো শহরের তখনকার শ্রদ্ধেয় নাম অ্যাডভোকেট মনির উদ্দিন আহমেদকে। আওয়ামী লীগের কোন শক্ত প্রার্থীই পাওয়া যাচ্ছিল না এই নির্বাচনে।
একই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন ইফতেখার হোসেন। তাঁকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই আমরা আগে জানতাম। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তাঁর কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। যদিও বিয়ে করেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এম পি মশহুদ চৌধুরীর মেয়ে নাজনীন চৌধুরীকে। এ সূত্র ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। সেবারের পৌর নির্বাচনে আ ফ ম কামাল বেশ ভালো ভোটে নির্বাচিত হয়ে নাগরিক সিলেটের এক জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠলেন।
সিলেট শহরে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক ছিল, যা আজও আছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বে তখন বেশ শূন্যতা। প্রবীণ নেতাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসা আছে। আওয়ামী লীগের এসব নেতার সৎ, উদারনৈতিক নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতাও ছিল প্রশ্নাতীত। তারপরও সাংগঠনিক কোন্দলে বেশ দুর্বল দেখা যায় শহর কেন্দ্রিক রাজনীতিতে। এর মধ্যেই ইফতেখার আওয়ামী লীগে যোগ দেন বেশ ঘটা করে। খুব দ্রুতই শামীম আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠলেন। একদম শহরের কেন্দ্রস্থলে তাঁর বাসাটি তখনকার ১৫ দল, পাঁচ দলসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের আস্তানা হয়ে উঠল।
একজন দক্ষ সংগঠক হলেও ভোটের রাজনীতিতে ইফতেখার কখনো ভালো করতে পারেননি। পৌর নির্বাচনে, উপজেলা নির্বাচনে হেরেছেন। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলই এসবের জন্য বেশ দায়ী বলে আজও মনে করা হয়। অথচ এরশাদবিরোধী আন্দোলন, ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনে তিনিই আওয়ামী লীগের একজন উজ্জ্বল নেতা হিসেবে উঠে আসছিলেন।
বদর উদ্দিন কামরান প্রবাসে থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নিত্যদিনকার কোন্দল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। যখন প্রবাস থেকে ফিরে গেলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন একজনকেই যেন খোঁজা হচ্ছিল। নিজের যোগ্যতায় তিনি দলে যেমন শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছিলেন, তেমনই জনতার প্রিয়ভাজনও হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। শহরের স্থানীয় লোক ছিলেন। একদম তরুণ বয়সে পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে নিয়ে চলার চমৎকার গুণ ছিল তাঁর। সিলেটের সহনশীল রাজনীতির এক যোগ্য মানুষ হয়ে উঠছিলেন। আমাদের রাজনীতির চলমান বাস্তবতায় এমন মানুষও এখন বিরল। যদি বলা হয়, কামরানের প্রধান গুন কি ছিল? তা হচ্ছে, তাঁর বিনয়। সদা হাস্য এ বিনয়ী মানুষটি আমাদের রাজনীতির সহজ ভাষাটা আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই।
সিলেট অঞ্চল থেকে এমনিতেই অগ্রসর মানুষদের উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের বাইরে চলে যান। গত চার দশকে রাজনীতি থেকে ভালো লোকজনের এমনিতেই সরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া চলছিল নানা কারণে। এর মধ্যে কামরান প্রবাস থেকে দেশে ফিরে গেলেন। বেশ দ্রুতই একজন সংগঠক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হলেন।
কামরানের ওপর হামলা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও উঠেছে। সবকিছুকে একজন সংগঠক হিসেবে মোকাবিলা করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
সিলেট পৌরসভা থেকে পৌর করপোরেশন হয়েছে। এই নগর আমাদের যৌবনের নানা স্মৃতিতে জেগে উঠে। সময়ের কোলাহলের মানুষ কামরানকে নিয়ে অনেকেই লিখবেন, বলবেন।
শুধুই মনে হচ্ছে, সুরমা পারের চেনা মানুষগুলো সব চলে যাচ্ছেন। বদলে যাচ্ছে নগরের জনারণ্য।
দেশ ছাড়ার দিন বিমান বন্দরেই দেখা কামরানের সঙ্গে। শেষ করমর্দনে সদা বিনয়ী এই মানুষটি বলেছিলেন, আমাদের একা রেখে চলে যাচ্ছেন?
বলেছিলাম, আবার দেখা হবে!
না, আর দেখা হয়নি। হবেও না!
বিনয় দিয়ে দ্রুতই মানুষের মন জয় করার স্বভাবজাত কৌশল কামরানের আয়ত্তে ছিল। আমাদের মতো বহুজনকে এমনই করে জয় করে গেছেন। শুধু সিলেটের মানুষ নয়, বাংলাদেশের মানুষ একজন কামরানকে মনে রাখবে ভালোবাসার উচ্চারণে।