কোনো ধরনের বড় এবং অভাবিত ঘটনা না ঘটলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগের সবচেয়ে বড় ঘটনা শেষ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের মধ্যে শেষ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে বৃহস্পতিবার রাতে। নির্বাচনের মাত্র ১২ দিন আগে যখন দুই প্রার্থী মুখোমুখি হয়েছেন, তখন তাঁদের সামনে ভোটারদের মন জয় করা ছিল প্রধান লক্ষ্য; কেননা এরপরে তাঁরা আর জাতীয় পর্যায়ে ভোটারদের মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পাবেন না। নির্বাচনী প্রচারাভিযান ইতিমধ্যেই কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ব্যাটল গ্রাউন্ডেই সীমিত হয়ে গেছে।
কিন্তু তাঁদের দুজনের আশু কাজ ছিল ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য প্রথম কাজ ছিল ২৯ সেপ্টেম্বরের প্রথম বিশৃঙ্খল বিতর্কে বেয়াড়া আচরণের পর তাঁর নিজের দল এবং সমর্থকদের আশ্বস্ত করা যে তিনি সংযত আচরণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, জনমত জরিপে জো বাইডেনের পক্ষে যে জনসমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে, তার গতি বদলে দেওয়ার মতো করে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেন তিনি। তৃতীয়ত, ভোটারদের এটা বোঝানো যে কেন তিনি বাইডেনের চেয়ে ভালো বিকল্প।
অন্যদিকে জো বাইডেনের প্রথম কাজ ছিল কোনো ধরনের ভুলভ্রান্তি না করে ইতিমধ্যে তাঁর পক্ষে যে জনমত আছে, তাকে ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, তাঁর সমর্থকদের বাইরে এখনো যাঁরা ভোট দেননি, তাঁদের কাছে এই আবেদন করা যে তাঁরা যেন তাঁকে ভোট দেওয়ার কথা বিবেচনা করেন। তৃতীয়ত, করোনাভাইরাস মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ধরনের পলিসি বা নীতিমালার প্রশ্নেই শুধু নয়, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি ট্রাম্পের চেয়ে ভিন্ন।
জো বাইডেন তাঁর কথাবার্তায় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা প্রতিরক্ষামূলক আচরণই করেছেন। বর্ণবাদের প্রশ্নে অন্য সময় যতটা শক্তভাবে ট্রাম্পের সমালোচনা করেন, এই বিতর্কে তা দেখা যায়নি।
৯০ মিনিটের এই বিতর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ ছিল সংযত, সেই অর্থে তিনি তাঁর প্রথম লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছেন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে রিপাবলিকান পার্টির যেসব নেতা এবং ট্রাম্প–সমর্থক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ছিলেন, তাঁরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। কিন্তু অপর দুই লক্ষ্য অর্জনে তাঁর সাফল্যের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি; অন্ততপক্ষে বিতর্কের পরে সিএনএনের চটজলদি জরিপ তা বলে না। সেখানে ৫৩ শতাংশ দর্শক বাইডেনকে বিজয়ী বলে মনে করেছেন; ট্রাম্প বিজয়ী হয়েছেন মনে করেছেন ৩৯ শতাংশ। কিন্তু এই বিতর্ক এ কারণে আলোচিত হবে তা নয়; বরং এ কারণে আলোচিত হবে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সহানুভূতিশীল মনোভাব দেখাতে ব্যর্থ হলেন একাধিকবার, তাঁর বক্তব্যে ও আচরণে ফুটে উঠল যে তিনি সহমর্মী আচরণে অভ্যস্ত নন।
ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপ ও নীতির কারণে সীমান্ত দিয়ে কথিত অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ২০১৮ সালের শরৎকাল থেকে আশ্রয়প্রার্থীসহ হাজার হাজার পরিবারকে সীমান্তে আটক করা হয়, পরিবারগুলোর কাছ থেকে তাঁদের সন্তানদের আলাদা করে ফেলা হয়। আন্তর্জাতিক এবং মার্কিন মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে সেই নীতিতে লাগাম টানা হলে পরিবারের কাছে সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়া শুরু হয়, কিন্তু এ সপ্তাহে জানা গেছে যে ওই সময় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ৫৪৫টি শিশুর পিতামাতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিতর্কে এ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শিশুদের ব্যাপারে সামান্যতম সহানুভূতি না দেখিয়ে ভিত্তিহীনভাবে বললেন যে এই শিশুদের নিয়ে এসেছে পাচারকারীরা। তিনি এ–ও বললেন, ‘এই শিশুদের ভালো যত্ন নেওয়া হচ্ছে’, ‘তাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন’। কিন্তু ২০১৯ সালে পরিদর্শকদের এবং গণমাধ্যমের সূত্রেই জানা গেছে যে শিশুদের রাখা হয়েছে খাঁচার ভেতরে, তাদের গোসলের ব্যবস্থা নেই, শীতের সময় তাদের গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়নি এবং অনেক সময় তাদের ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাটাতে হয়েছে। ট্রাম্পের এ মন্তব্যের বিপরীতে জো বাইডেন যখন বললেন এগুলো হচ্ছে অপরাধ, এগুলো আমাদের হাস্যকর করে তুলেছে, এটি জাতি হিসেবে আমরা যা, সেই ধারণার বরখেলাপ—তাতেই দুই প্রার্থীর পার্থক্য বোঝা গেল। ব্যক্তি হিসেবে ট্রাম্পের চেয়ে নিজেকে আলাদা দেখানোর লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাইডেনকে সম্ভবত আর কিছুই করতে হতো না।
একইভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে যখন প্রশ্ন করা হয়, দেশের কৃষ্ণাঙ্গ এবং অন্য বর্ণের পিতামাতারা তাঁদের সন্তানদের ঘরের বাইরে পুলিশের মুখোমুখি হলে যে ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করার কথা বলেন, তা তিনি বোঝেন কি না? প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর উত্তরে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেন। পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে এবং তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বলে পরিবারগুলো এ ধরনের সাবধানতার শিক্ষা দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া বলে দিয়েছে যে দেশে কাঠামোগত বর্ণবাদের উপস্থিতি বিষয়ে তিনি কথা বলতে চান না। শুধু তা–ই নয়, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকে সহিংস বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করলেন, তাতেও সেই মনোভাব প্রকাশিত। একইভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে এবং তাঁর প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপের আলোচনায় প্রেসিডেন্ট একবারও যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের কথা স্মরণ করেননি। তিনি করোনাভাইরাসের প্রসঙ্গকে বারবার নিয়ে গেছেন অর্থনীতির প্রশ্নে।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শিশুদের ব্যাপারে সামান্যতম সহানুভূতি না দেখিয়ে ভিত্তিহীনভাবে বললেন যে এই শিশুদের নিয়ে এসেছে পাচারকারীরা। তিনি এ–ও বললেন, ‘এই শিশুদের ভালো যত্ন নেওয়া হচ্ছে’, ‘তাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন।’
জো বাইডেন তাঁর কথাবার্তায় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে খানিকটা প্রতিরক্ষামূলক আচরণই করেছেন। বর্ণবাদের প্রশ্নে অন্য সময় যতটা শক্তভাবে ট্রাম্পের সমালোচনা করেন, এই বিতর্কে তা দেখা যায়নি। দৃশ্যত বাইডেন তাঁর সমর্থকদের কোনো অংশের কাছেই বিতর্কিত কোনো বক্তব্য রাখতে চাইছিলেন না। কিন্তু তাতে তিনি শতভাগ সফল হয়েছেন এমন বলা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘ফসিল ফুয়েল’ বা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার বিষয়ে যা বলেছেন, তা ভুলভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনি ক্রমান্বয়ে তেলশিল্পের ওপর থেকে ভর্তুকি তুলে নেবেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিতর্কের সময়ই একে তেলশিল্প ধ্বংস করা বলে অভিহিত করেছেন এবং তেল উৎপাদনকারী রাজ্যগুলোর ভোটারদের এ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। এতে বাইডেন ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কি না, সেটা পেনসিলভানিয়ার আগামী কয়েক দিনের জনমত জরিপেই বোঝা যাবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর।