করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আমেরিকার জরুরি বিভাগগুলোর কর্মীদের কাজে যোগ দিতে বলা হচ্ছে। সেন্টার ফর ডিসিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) থেকে নতুন নির্দেশনা এসেছে। বলা হয়েছে, এসব জরুরি কর্মী দিনে দুইবার নিজের দেহের তাপমাত্রা দেখবেন ও মাস্ক পরবেন, যাতে নিজেরা আক্রান্ত হলেও অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে না পড়ে।
ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিউইয়র্ক। ৯ এপ্রিল ভোরের দিকে এ প্রতিবেদন লেখার সময় খবর পাওয়া যায় বাংলাদেশিদের অন্যতম প্রিয় চিকিৎসক বাংলাদেশি আমেরিকান ড. রেজা চৌধুরী করোনায় মারা গেছেন। এ নিয়ে আমেরিকায় ৯১ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
এর মধ্যে অনেকেই করোনার কবল থেকে ফিরে এসেছেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সুস্থ হচ্ছেন এমন প্রবাসীর সংখ্যাও অনেক। কমিউনিটির পরিচিত মুখ সৈয়দ ইলিয়াস খসরু, সাবেক ছাত্রনেতা শাহাব উদ্দিন, সাংবাদিক ফরিদ আলম, পুলিশ বিভাগের খন্দকার আব্বাসসহ অনেকেই সুস্থ হয়েছেন। সংকটের এ সময়ে তাঁরা সবার কাছে দোয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কমিউনিটির বেশ কয়েকজন এখনো অসুস্থ। প্রতিটি জীবন কেবল একটা সংখ্যা–ই নয়, একেকটা জীবনহানি। অনেক কিছুই বদলে দিচ্ছে এসব মৃত্যু। পরিবারের, সমাজের, কমিউনিটির মধ্যে যে অপূর্ণতা এনে দিচ্ছে, তার পরিণাম নিয়ে শিহরিত সবাই।
সাম্প্রতিক ইতিহাসে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের হামলায় নিউইয়র্কে ২ হাজার ৭৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। করোনাভাইরাসের মৃত্যুর সংখ্যা ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল ৬ হাজার ২৬৮ জন। এতো অফিশিয়াল হিসাব, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।
নিউইয়র্ক নগরের মেয়র বলেছেন, হাসপাতালে আসার আগেই নগরের যেসব মানুষ করোনাভাইরাসে মারা গেছে, তাদের হিসাব এখনো জানা যায়নি। এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। স্বজন হারানোয় কাতর শোকের রাজ্য নিউইয়র্কে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশের রাজ্য নিউজার্সিতেও উড্ডীন অর্ধনমিত পতাকার সঙ্গে স্বজন–পরিজন হারানোর বেদনার বার্তাই উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র।
নিউইয়র্কে হাসপাতালে ভর্তি টানা তিন দিন কিছুটা কমেছে। তবে নগরের কোন হাসপাতাল খালি নেই। শারীরিক অবস্থা সংকটজনক না হলে রোগীকে হাসপাতালে এখন ভর্তি করা হচ্ছে না। যারা গত এক মাসে ভাইরাসে নানাভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের সংকটকাল চলছে। লকডাউন ও বিচ্ছিন্নতা নতুন করে ছড়ানো সীমিত করলেও আগের ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসে এখনো লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ কারণেই রাজ্য গভর্নর থেকে সবাই আশঙ্কা করছেন, পরের দুই সপ্তাহে মৃত্যুর তালিতকায় বহু নাম যোগ হবে। হাসপাতালে ভর্তি যদি আবার না বাড়ে, মাসের শেষের দিকে একটা স্বস্তিকর অবস্থা দেখার আশার কথা জানাচ্ছেন তাঁরা।
বুধবার রাত পর্যন্ত নিউইয়র্ক নগরে মোট মৃত্যু ৪ হাজার ২৬০ জন বলে রেকর্ড করা হয়েছে। মৃতের এই সংখ্যাটি প্রকৃত চিত্র নয় বলে মেয়র বিল ডি ব্লাজিও নিজেই বলেছেন। নগরের ফায়ার সার্ভিস বলেছে, তারা যেখানে দিনে ২০/২৫টি মৃত্যুর রেকর্ড করেছে স্বাভাবিক সময়ে, সেখানে করোনা তাণ্ডবের সময়ে তাদের কাছে প্রতিদিন গড়ে ২০০ লোকের মৃত্যুর তথ্য রয়েছে। সিটি কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। হাসপাতালে যাওয়ার আগে বা ঘরবাড়িতে যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের গণনায় আনার পর সংখ্যাটি আরও ভীতিকর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
নগরের বিভিন্ন এলাকায় তৈরি খাবার দেওয়া হচ্ছে। নগর কর্তৃপক্ষ ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, চ্যারিটি সংগঠন মানবিক কাজে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সংগঠন থেকে শুরু করে ব্যক্তিবিশেষ নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিপদসংকুল লোকজনের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন।
লোকজন কর্মহীন। দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। নিউইয়র্কে ৫০ লাখ লোক স্থায়ীভাবে কর্মহীন হয়ে পড়বে সহসাই। সরকারি সহযোগিতার চেক পাওয়ার আশায় লোকজন দিন গুনছেন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বেকার ভাতার জন্য অনেকে আবেদন করে ইতিমধ্যে ভাতা পেতে শুরু করেছেন। যদিও বড় একটি অংশ এখনো আবেদনই করতে পারেননি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য যে প্রণোদনার কথা বলা হয়েছে, সেসবও নানা কাগজের বাধ্যবাধকতায় কে কতটা পাবেন, এ নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। আমাদের কমিউনিটির বহু ব্যবসা-বাণিজ্যের সঠিক রেকর্ড নেই। সরকারি যেকোনো ঋণ বা অনুদানের জন্য এসব রেকর্ড এখন কে কোথায় পাবে?
যারা কাগজপত্রহীন অভিবাসী, তাদের কে দেখবে? তাদের জন্য কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেই। লুকোছাপা করে কাজ করারও সুযোগ নেই। নিউইয়র্কের সর্বত্র কান্নার রোল। এ কান্না থামছে না। বিলাপধ্বনি আজ সর্বত্র।