নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে ক্যাপিটল হিলে ঢুকে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকেরা
নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে ক্যাপিটল হিলে ঢুকে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকেরা

শেষলগ্নে বড় অঘটন ঘটালেন ট্রাম্প

২০২১ সালে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে প্রথম আলো অনলাইন। আয়োজনের ১১তম লেখাটি এখন প্রকাশিত হলো।

অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বিক্ষোভ, সহিংসতা, রক্তপাত, প্রাণহানি—বিদায়ী বছরটিতে যুক্তরাষ্ট্রে কী ছিল না!

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এমন সব ঘটনার সাক্ষী হয়, যা ছিল অভূতপূর্ব। শুধু মার্কিন জনগণই নয়, বিশ্বও এসব ঘটনায় বিস্মিত।

২০ জানুয়ারি সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে রেকর্ড করেন জো বাইডেন। দেশটি প্রথমবারের মতো কোনো নারীকে (কমলা হ্যারিস) ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পায়। তবে এসব ছাপিয়ে যায় দেশটির পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের হামলা।

পরাজিত কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে হামলার জন্য তাঁর সমর্থকদের উসকে দিয়েছেন, এমন ঘটনা আগে কখনো দেখেনি যুক্তরাষ্ট্র।

এ হামলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হুমকিতে পড়ে। একই সঙ্গে দেশটির রাজনৈতিক বিভেদ যে কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছে, তা সামনে আসে।

পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্প এখন পর্যন্ত বাইডেনকে অভিনন্দন জানাননি। তিনি পরাজয়ও মেনে নেননি। বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানেও যাননি।

১৭৯৩ সালে ক্যাপিটল হিলের নির্মাণ শুরু হয়। ১৮০০ সালে এই ভবনে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রম চালুর পর বিভিন্ন সময় ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বদলে দিতে পরাজিত প্রার্থীর উগ্র সমর্থকদের পার্লামেন্ট ভবনে হামলার ঘটনা নজিরবিহীন।

৬ জানুয়ারির হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদেরা বলেন, ১৮১৪ সালে ক্যাপিটল ভবন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনারা। সেই ঘটনার পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্যাপিটলের নিয়ন্ত্রণ হারালেন।

ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে নয়, পুরো বিশ্বকেই হতবাক করে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সেদিন সকাল থেকে দুদিকে দুই ধরনের প্রস্তুতি চলছিল।

একদিকে প্রস্তুতি চলছিল বাইডেনের বিজয়ের স্বীকৃতি দেওয়া। এই প্রস্তুতি চলছিল ক্যাপিটল হিলে। এ জন্য কংগ্রেসের যৌথ সভা বসেছিল।

অন্যদিকে ট্রাম্পের উগ্রবাদী সমর্থকেরা জড়ো হচ্ছিলেন হোয়াইট হাউসের পাশের একটি পার্কে। দুপুরে হামলার আগে সমর্থকদের উদ্দেশে ট্রাম্প বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্যাপিটল হিলের দিকে যাত্রা করব। আমাদের সাহসী সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যদের উৎসাহিত করব।...আমাদের দৃঢ়তা দেখাতে হবে।’

এসব কথা বলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে যান। বেলা দুইটার দিকে ট্রাম্পের সমর্থকেরা শেষ ব্যারিকেডটি ভেঙে ক্যাপিটল হিলের ভেতরে ঢুকে যান। চার ঘণ্টা ধরে সেখানে তাণ্ডব চলে।

ক্যাপিটল হিলে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কক্ষ ভাঙচুরের পর তাঁর চেয়ারে বসে আছেন ট্রাম্পের সমর্থক

হামলা থেকে বাঁচতে অনেক আইনপ্রণেতা লুকিয়ে পড়েন ডেস্কের পেছনে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে সরিয়ে নেন। তারপর অন্য সদস্যদের সরিয়ে নেওয়া হয়।

হামলার ঘটনায় পুলিশসহ পাঁচজন নিহত হন। আহত শতাধিক। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থা এই হামলাকে ‘স্থানীয় সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে আখ্যা দেয়।

হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিভিন্ন নথি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, এমন পরিস্থিতির যে সৃষ্টি হতে পারে, তা আগেই আঁচ করা হয়েছিল। কিন্তু এমন আশঙ্কার বিপরীতে প্রশাসনের প্রস্তুতি ছিল অপ্রতুল।

ক্যাপিটলে হামলার পর ট্রাম্প প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন। আগেও একবার তিনি অভিশংসিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম ক্ষমতাসীন কোনো প্রেসিডেন্টকে দুবার প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হতে দেখল।

৬ জানুয়ারির হামলার পর ট্রাম্পকে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি ওঠে। ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টির কয়েকজন নেতা এই দাবির পক্ষে মত দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। বিষয়টি সিনেটে আটকে যায়।

হামলায় উসকানির দায়ে ট্রাম্পকে নিষিদ্ধ করে ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিকমাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে।

ট্রাম্পের সমর্থকদের হামলার মুখে মেঝেতে আশ্রয় নেন কংগ্রেস সদস্যরা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। কোনো কোনো বিশ্বনেতা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের এমন লেজেগোবরে অবস্থা নিয়ে খোঁচা পর্যন্ত দেন।

ট্রাম্পের উসকানিতেই যে ক্যাপিটলে হামলা হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হামলার কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি একটি টুইটে বলেছিলেন, বড় প্রতিবাদ হবে ৬ জানুয়ারি। সেখানে উপস্থিত থেকে সমর্থকদের ক্ষমতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

ক্যাপিটল হিলে হামলার ঘটনার তদন্ত এখনো চলমান। তদন্তের অংশ হিসেবে কিছু নথি চেয়েছে হাউস কমিটি। তবে ট্রাম্পের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এসব নথি প্রকাশ সাময়িক স্থগিত করেছেন একটি আদালত।

ট্রাম্পের হাজারো উগ্র সমর্থকের হামলায় ৬ জানুয়ারি রক্তাক্ত হয় ক্যাপিটল হিল

ক্ষমতা থেকে ট্রাম্প বিদায় নিলেও তিনি এখনো রাজনীতিতে সক্রিয়। রিপাবলিকান পার্টির ওপর তাঁর প্রভাব লক্ষণীয়। তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চান। তবে আপাতত তাঁর চোখ ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি তাঁর দল ভারী করতে চান।

ট্রাম্প বরাবরই আলোচনায় থাকতে ভালোবাসেন। নানা কর্মকাণ্ড ও মন্তব্যের কারণে তিনি তাঁর শাসনামলজুড়ে আলোচনায় ছিলেন। যেসব নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে তিনি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাতে ইতিহাস তাঁকে এক চরম বিতর্কিত নেতা হিসেবেই মনে রাখবে।

তথ্যসূত্র: টাইম ম্যাগাজিন, নিউইয়র্ক টাইমস, রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি, হিস্টোরি ডটকম