বছর দশেক আগের ঘটনা। আমি তখন ক্যাব চালাতাম, তাও রাতের শিফটে। নিউইয়র্ক শহরে রাতের শিফটে ক্যাব চালাতে বুকের পাটা লাগে। চোর, ছিনতাইকারী, ড্রাগ ডিলারের অভাব নাই এই শহরে। যাই হোক, সে রাতে ম্যানহাটনের ফাইন্যান্সিয়াল ডিসট্রিক্ট থেকে এক চাইনিজ মেয়ে গাড়িতে উঠেছে। রাত তখন অনেক গভীর। তিনটা কিংবা চারটা হবে। মেয়েটিকে গাড়িতে ওঠানোর আগে আমি তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়েছি। এখন আপনারা নিশ্চয়ই ভাবছেন, ব্যাটা বদ! মেয়ের দিকে কীভাবে তাকিয়েছ, তা লেখার কী দরকার ছিল—‘সব পুরুষই এক’! আপনি যদি এমন ধারণা পোষণ করেন, তাহলে বিরাট ভুল করছেন। কেন তাকিয়েছি এবার সে কারণ বলা যাক।
রাতের বেলা এই শহরের বেশির ভাগ লোকই মাতাল থাকে। শুক্রবার/শনিবার হলে তো কথাই নেই। সে রাতগুলো পার্টি নাইট। লোকজন ভোর চারটা, পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাবে/বারে সময় কাঁটায়। এসব রাতে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক, এঁদের গাড়িতে ওঠানোর আগে আমরা ক্যাবওয়ালারা প্রতিটা প্যাসেঞ্জারের দিকে ভালোভাবে তাকাই। আমাদের অভিজ্ঞ চোখ প্যাসেঞ্জারকে মেটাল ডিটেক্টরের মতন স্ক্যান করে। সে কী ঢুলছে, তার চোখগুলা কী গ্লাসি (প্রচুর মদ্যপান করলে গ্লাসি আইস হয়), তার কথা কী জড়িয়ে যাচ্ছে, মুখ থেকে কী অ্যালকোহলের বদ গন্ধ আসছে? ইত্যাদি। এসব ব্যাপার লক্ষ্য না করে গাড়িতে লোক ওঠালে ধরা খাবার চান্স ১০০ ভাগ। সে গাড়িতে ওঠে বমি করতে পারে, ঘুমিয়ে পড়তে পারে—এককথায় নানান সমস্যা!
একবার এক মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তাঁর বাড়ির সামনে পৌঁছানোর পর তাঁকে ডাকলাম। কোন সাড়াশব্দ নেই। গায়ে হাত দিয়ে তাঁকে জাগানোর প্রশ্নই ওঠে না, তবে পুরুষ হলে অন্য কথা। সে রাতে আমার কপাল ভালো ছিল। সাইড ভিউ মিররে চোখ পড়তেই দেখলাম পুলিশের গাড়ি আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি থেকে নেমে পুলিশের গাড়িকে দুহাত উঁচিয়ে থামালাম। পুলিশ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক করে গাড়ি থামাল। থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী সমস্যা?
হাত ইশারা করে বললাম, ‘প্যাসেঞ্জার ঘুমিয়ে পড়েছে’।
দুই পুলিশের একজন ছিল বিশাল আকৃতির মহিলা। সে গাড়ি থেকে নামল। দরজা খুলে সে তাঁর গাবদা গাবদা হাত দিয়ে প্যাসেঞ্জার মেয়েটির গায়ে ভালোমতো একটা ঝাঁকানি দিল। মেয়েটি উঠল না। এবার সে ‘মিস’ ‘মিস’ বলে আলতো করে মেয়ের দুই গালে দুটো চড় দিল এবং সে চড়েই কাজ হল।
লং স্টোরি শর্ট। পুলিশ সে রাতে মেয়েটির ব্যাগ থেকে টাকা বের করে আমার ভাড়া দিয়েছিল, এমনকি টিপসও দিয়েছিল। পরে মেয়েটিকে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিই। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, সে রাতে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। পুলিশ না এলে সেদিন আমি কী সমস্যায় পড়তাম! আমাকে ৯১১ এ কল করতে হতো। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। পুলিশের লোকজন এসব ইমারজেন্সি তেমন পাত্তা দেয় না। ধীরে–সুস্থে অনেকক্ষণ পরে আসে ওদিকে আমি গরিব ট্যাক্সিওয়ালার বাঁশ। লেট হয়ে যাচ্ছে, গ্যারেজে গাড়ি জমা দিতে হবে। বেশি দেরি হলে গ্যারেজের ডেসপেচার জরিমানা করবে। নানান ফ্যাঁকড়া।
যাই হোক, মূল গল্পে ফিরি। চাইনিজ মেয়েটি মাতাল না। স্বাভাবিক মানুষ, তবে তাঁর পোশাক–আশাক, বেশভূষা অতি উগ্র। তাঁর পরনে যে হাফ প্যান্ট, সেটাকে হাফপ্যান্ট না বলে জাঙ্গিয়া বললেই বেশি মানায়।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবে?
সে ঠিকানা বলল। লম্বা রাস্তা। যেতে আধঘণ্টার মতন লাগবে। ৫৫/৬০ ডলারের ভাড়া। আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠল। ট্যাক্সিচালকদের আনন্দ–বেদনা সবকিছুই ভাড়াকেন্দ্রিক।
লম্বা রাস্তা=বেশি ভাড়া+আনন্দ আর সেই যাত্রী যদি ট্যাক্সিওয়ালা যে এলাকায় থাকেন, সেই এলাকায় যায় তাহলে তো বিমলা-নন্দ! ছোট রাস্তা+কম ভাড়া=এখানে আনন্দের কিছুই নেই!
আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমি গাড়ি চালাচ্ছি, সে পেছনের সিটে বসে ফোন টিপছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, সে তার পা দুটি রেখেছে আমার ডানদিকের সিটের হেড-রেস্টে। এরা এভাবেই বসে অতএব আমি কিছু বললাম না। আমি যদি ঢাকা শহরের ট্যাক্সিচালক হতাম হয়তোবা তাকে ফট করে বলে ফেলতাম, ‘আপা ওইখানে পা রাখছেন ক্যান? মানুষজন মাথা রাখে! ইত্যাদি! বলাই বাহুল্য, এ দেশে এসব সস্তা মানসিকতা পুরোপুরি অচল।
ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়েছি। রেডলাইট। মেয়েটা আমাকে ডাকল, ‘স্যার’
আমি মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালাম।
সে বলল, আমার পাগুলো খুব সুন্দর, তাই না?
এই প্রশ্ন শুনে আমার ভিমড়ি খাবার জোগাড়! আমার চোখ পড়ল তাঁর পায়ের ওপর। তার পা অবশ্যই সুন্দর! এরা হাতের পায়ের অনেক যত্ন নেয়। ট্যানিং সেলুনে যায়, ওয়াক্স করে, হাতে ম্যানিকিওর, পায়ে প্যাডিকিওর—এ রকম অনেক কিছুই করে। তাকে খুশি করার জন্য বললাম, অফকোর্স! তোমার পাগুলো খুব সুন্দর।
এ কথা বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমার প্রশংসায় খুশি হয়ে সে আমাকে হয়তোবা একটু বেশি টিপস দেবে। এখানে একটা তথ্য দিই। ট্যাক্সি চালিয়ে আমরা বছরে যা কামাই করি, তার মোটামুটি বড় একটা অংশজুড়ে থাকে প্যাসেঞ্জারের দেওয়া বকশিশ বা টিপস।
গাড়ি তখন হাইওয়েতে। গভীর রাত। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। আমি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। একে নামিয়েই বাসায় যাব। রুই মাছ দিয়ে এক প্লেট ভাত খাব, কিছুক্ষণ টিভি দেখব তারপর ঘুম। এক ঘুমে দুপুর, বিকালবেলা।
বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। সপ্তাহে একটা দিনই নিজের মতো করে কাটাই! আমি যখন এসব আকাশ-পাতাল ভাবছি, ঠিক তখনই মেয়েটি বলল, I like your driving!
আমি রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে বললাম, থ্যাংকস।
মেয়েটি বলল, ‘আমি ইন্ডিয়ান/পাকিস্তানি ড্রাইভারদের ড্রাইভিং খুব পছন্দ করি।’
আমি বললাম, ‘আমি ইন্ডিয়ান/পাকিস্তানি কিছুই নই, আমি বাংলাদেশি!’
সে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ওহ রিয়েলি? আই লাভ বাংলাদেশি গাইজ। জানো, একবার আমার কাছে ভাড়ার টাকা ছিল না। আমার বাংলাদেশি ড্রাইভারকে আমি সে রাতে অন্যভাবে তা পুষিয়ে দিয়েছি!
প্রিয় পাঠক, কথাবার্তা ওই মুহূর্তে কোনদিকে এগোচ্ছে আমার তখন আর বুঝতে কিছুই বাকি নেই।
আমি রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীভাবে পুষিয়ে দিয়েছিলে?’
মেয়েটি বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে বলল, ‘ইউ নো’!
আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা। এই মেয়ে কী আমার ভাড়া দেবে? তার কাছে কী ভাড়ার টাকা আছে? যদি না থাকে? তখন কী হবে? গাড়ি চলছে। ততক্ষণে হাইওয়ে থেকে এক্সিট নিয়ে আমি মেয়েটির গন্তব্যের বেশ কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। এই এলাকা আমার পরিচিত। পুলিশ প্রিসেন্ট কোথায়, তা আমার জানা। ভাবলাম মেয়েটিকে কী আমি সরাসরি পুলিশ প্রিসেন্টে নিয়ে যাব? গিয়ে কোন পুলিশ অফিসারকে বলব, সে আমার ভাড়া দিচ্ছে না? ‘Theft of service case’–এ মেয়েটিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে, এক হাজার ডলার জরিমানা করবে, ছয় মাসের জেল হবে। আবার ভাবলাম, সে তো আমাকে এখনো সে রকম কিছু বলেনি। তার কাছে নিশ্চয়ই টাকা আছে!
মেয়েটি যে রাস্তায় থাকে, সেই রাস্তাতে ঢুকতেই সে বলল, ‘রাস্তার একেবারে শেষ মাথার বাঁ দিকে যে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং আমি সেই বিল্ডিংয়ে থাকি।’
বিল্ডিংয়ের মূল দরজার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালাম। দরজার লকটাকে টিপে ধরলাম যাতে ভাড়া না দিয়ে পালাতে না পারে। এ রকম ঘটনা যে আমার জীবনে ঘটেনি, তা কিন্তু না। অনেকবারই ঘটেছে।
গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। মেয়েটি বলল, ‘পেছনের লাইটটা জ্বালাবে আমি অন্ধকারে কিছুই দেখছি না।’
আমি লাইট জ্বালালাম। সে ব্যাগ হাতড়াতে হাতড়াতে বলল, ভাড়া কত হয়েছে।
আমি ট্যাক্সি মিটারের দিকে হাত ইশারা করে বললাম, ‘ওই দেখো, আটান্ন ডলার।’
সে মিটারের দিকে এক পলক তাকিয়ে আমাকে দিকে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আমার কাছে টাকা আছে, তবে তুমি যদি চাও আমি তোমাকে টাকা না দিয়ে অন্যভাবেও খুশি করে দিতে পারি!’
আমার মেজাজ তখন মোটামুটি সপ্তমে চড়ে আছে। তারপরও নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললাম, ‘আমাকে আমার ভাড়া–ই দাও, আমি অন্য কোনোভাবে খুশি হতে ইচ্ছুক নই!’
সে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওকে এজ ইউ উইশ!’
সে আমাকে তিনটা বিশ ডলারের নোট দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আমি তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম ‘কত বিচিত্র চরিত্রের মানুষই-না এই পৃথিবীতে আছে!
(আমার ধারণা, এই মেয়েটি খুব সম্ভব মাদকাসক্ত ছিল। মাদকের টাকা বাঁচাতে সে নিশ্চয়ই এমন কাজ আরও অনেকবার করেছে।)